গল্পঃ প্যারাস্যুট




বাতাসটা যেন হাজারটা তীক্ষ্ণ ছুরির মতো আমার গালে, আমার কানের লতিতে বাড়ি মারছিলো। আমি নিচে, শুধু নিচে পড়ছিলাম, যেন মহাকর্ষের কোনো অমোঘ নিয়মে বাঁধা একটা পুতুল। একটু আগে যখন প্লেন থেকে লাফ দিয়েছিলাম, বুকটা অদ্ভুত এক অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে নেচে উঠেছিল। মনে হচ্ছিলো, আমি যেন আকাশের রাজা, এই বিশাল নীল ক্যানভাসে আমিই একমাত্র রঙিন তুলি। নিচে দেখা যাচ্ছিলো আমাদের দেশটা, সবুজের সমুদ্র, তাতে ছোট ছোট ঘরবাড়ি, নদীগুলো যেন চিকন রূপালি ফিতা। সে এক স্বপ্নিল দৃশ্য ছিল!


কিন্তু এখন? এখন সেই স্বপ্নটা একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। আমার ডান হাতটা কাঁপছিল, বারবার প্যারাস্যুটের লাল হ্যান্ডেলটা খুঁজছিল। টানতে হবে, খুলতে হবে! এটাই তো নিয়ম। প্রথমবার টানলাম – কিছু হলো না। বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো। দ্বিতীয়বার, আরও জোরে – না, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই! একটা ঠান্ডা বরফের স্রোত যেন শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। আহিয়ান, তুই কি করছিস! আমার হাত-পা যেন নিজের কথা শুনছিল না। প্যারাস্যুটের ফিতাগুলো আমার শরীরের সঙ্গে শক্ত হয়ে আটকে ছিল, চামড়ায় ব্যথা হচ্ছিলো, কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমার মনোযোগ কেবল সেই লাল হ্যান্ডেলটার দিকে, যেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে নাকি আমিই ধরতে পারছি না।


বাতাসটা শুধু শব্দ নয়, একটা ঠাণ্ডা, তীক্ষ্ণ গন্ধ নিয়ে আসছিল। আমি যেন অনুভব করছিলাম, বাতাসের ভেতরে থাকা লক্ষ লক্ষ কণার চাপ। মুখটা শুকিয়ে কাঠ। জিহ্বাটা তালুর সঙ্গে আটকে গেছে। নিচে মাটিটা এখন আর মার্বেল নয়, একটা বিশাল সবুজ গালিচার মতো লাগছে, যেটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে আরও বড় হচ্ছে। এর ভেতরেই আমার গ্রামের খেতের সোনালি ধান, আমাদের টিনের চালের বাড়িটা, আমবাগান – সব মিশে আছে। কী অদ্ভুত, এত উপরে থেকেও আমি একটা মায়াবী টানে ওদেরকে খুঁজে ফিরছিলাম।


আমার মনে হলো, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে একমাত্র সত্য হচ্ছে এই পতন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা সবাই তো পড়ছি। শুধু গতিটা ভিন্ন। কিছু মানুষ ধীরে ধীরে, কিছু মানুষ দ্রুত। কিন্তু গন্তব্যটা কি একই? আমার মস্তিষ্কটা যেন সহস্র গতিতে দৌড়াচ্ছিল। আমি কি মারা যাচ্ছি? এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কি আমার সব শেষ হয়ে যাবে? আমার লেখা সেই অসমাপ্ত গল্পটা, আমার মায়ের হাসিমুখ, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পরিকল্পনা – সব? একটা অব্যক্ত কষ্ট যেন বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠছিল। না, এটা হতে পারে না। আমি বাঁচতে চাই!


- - -


একটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে আমার শরীরটা যেন সজাগ হয়ে উঠলো। ডান হাতের আঙুলগুলো অবচেতনভাবেই আমার পেটের কাছে, রিজার্ভ প্যারাস্যুটের হ্যান্ডেলটার খোঁজে গেল। এটাই শেষ ভরসা, শেষ সুযোগ! মেইন প্যারাস্যুট যখন কাজ করছে না, তখন রিজার্ভই একমাত্র পথ। আমি একবার একটা ডকুমেন্টারিতে দেখেছিলাম, মেইন প্যারাস্যুট না খুললে কী করতে হয়। তখন মনে হয়েছিল, দূর! ওসব তো সিনেমার জিনিস। কিন্তু আজ আমি নিজেই সেই সিনেমার অংশ।


হাতটা কাঁপছিল, কিন্তু চেষ্টা করলাম শক্ত হতে। নীলচে হ্যান্ডেলটা, যেটা মেইনটার থেকে একটু ছোট, সেটার ওপর আমার আঙুলগুলো গিয়ে পড়তেই একটা অদ্ভুত শান্তি যেন আমার বুক ভরে উঠলো। একটা ক্ষীণ আশা, একটা ছোট্ট আলোর রেখা। জোরে টানলাম! এবার আর কিছু ভাবতে চাই না, শুধু খুলুক! প্লিজ, খুলুক!


বাতাসের গমগমে শব্দটা যেন আরও বেড়ে গেল। কানের পর্দায় একটা অসহ্য চাপ অনুভব করছিলাম। আমার সামনে এখন পৃথিবীটা একটা বিশাল চিত্রপটের মতো, যেখানে সবুজ আর বাদামি রঙের ছোপ। ঘরবাড়িগুলো স্পষ্ট হচ্ছে, গাছগুলোও বড় বড় লাগছে। আমি যেন খুব দ্রুত একটা বিশাল কোলাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি নিচে পড়ার সময় আমার চোখগুলো থেকে অবিরত পানি ঝরছিল, বাতাসের তীব্রতার কারণে। তবে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই অশ্রুগুলো ভয়ের কারণে নয়, বরং জীবনের প্রতি এক গভীর ভালোবাসার কারণে।


একটা মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো, আমি কি শেষবারের মতো এই প্রকৃতির সব সৌন্দর্য দেখে নিচ্ছি? ওই দূরের নদীটার জল এখন চিকচিক করছে, মনে হচ্ছে যেন কেউ রুপোর গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে। পাশের গ্রাম থেকে হয়তো ভেসে আসছে মানুষের কোলাহল, হয়তো কোনো মায়ের গান বা শিশুর কান্না। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না, কেবল বাতাসের সেই আদিম গর্জন ছাড়া। কিন্তু আমি কল্পনা করছিলাম সেসব। আমার কল্পনার ক্ষমতা এই শেষ মুহূর্তেও আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিল।


আমার ভেতরটা চিৎকার করে বলছিল, “আহিয়ান, তুই হাল ছাড়বি না!” কিন্তু আমার শরীরটা যেন তার নিজের ইচ্ছায় চলছিল। আমার সমস্ত শক্তি যেন ওই রিজার্ভ প্যারাস্যুটের হ্যান্ডেলটায় কেন্দ্রীভূত হয়ে ছিল। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড… খুলছে না তো! আবার কি সেই বিভীষিকাময় অবস্থা? আমার পায়ের বুড়ো আঙুলগুলো অবশ হয়ে আসছিল, ঠোঁট দুটো আপনাতেই কেঁপে উঠলো। একটা অচেনা ঠান্ডা ভয় বুকের ভেতর জমাট বাঁধতে শুরু করলো। মনে হলো, আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন এই মুহূর্তে শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুকে একসঙ্গে পাম্প করে বের করে দিতে চাইছে।


- - -


হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ, কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া শব্দ হলো, যেন একটা বিশাল কাপড়ের পর্দা ছিঁড়ে গেল। একই সাথে, আমার শরীরে একটা প্রচণ্ড টান অনুভব করলাম। এমন যেন মনে হলো, অদৃশ্য এক দৈত্য আমাকে নিজের দিকে টেনে ধরছে। আমি মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেললাম। যখন আবার চোখ খুললাম, দেখলাম আমি আর অবাধে পড়ছি না। হ্যাঁ, প্যারাস্যুট খুলেছে! একটা বিশাল কমলা রঙের ছাতা আমার মাথার উপর দুলে উঠছে, বাতাসে দোল খাচ্ছে। স্বস্তির একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম, আমি কখন শ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার শরীরের প্রতিটি তন্ত্রী যেন শিথিল হয়ে গেল।


বাতাসের সেই ভয়ানক গর্জনটা এখন একটা নরম, ফিসফিসে শব্দে পরিণত হয়েছে। আমি যেন একটা বিশাল গাছের পাতার মতো, ধীরে ধীরে নিচে নামছি। সূর্যটা আমার মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে, আর কমলা রঙের প্যারাস্যুটের মধ্য দিয়ে আসা আলোটা আমার চারপাশটাকেও একটা সোনালি আভা দিচ্ছিলো। মনে হলো, আমি যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি। একটা অদ্ভুত শান্তি আর প্রশান্তি আমাকে ঘিরে ধরলো। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সব চিন্তা, সব ভয়, সব দুশ্চিন্তা আমার থেকে অনেক দূরে, নিচে পড়ে আছে।


আমি নিচে তাকালাম। আমার গ্রামটা এখন অনেক শান্ত, অনেক সুন্দর লাগছে। সবুজ ধানক্ষেতগুলো যেন একে অপরের হাত ধরে দিগন্তে মিশে গেছে। দূরে ছোট ছোট ঘরবাড়িগুলো খেলনার মতো দেখা যাচ্ছে, তাদের টিনের চালগুলো সূর্যের আলোতে চকচক করছে। আমি স্পষ্ট অনুভব করছিলাম, বাতাসের একটা হালকা প্রবাহ আমার গালে এসে লাগছে। বাতাসটা ছিল সতেজ, মাটির গন্ধ আর ভিজে ঘাসের একটা মৃদু ঘ্রাণ নিয়ে। আমি চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস নিলাম। যেন জীবনের স্বাদটা প্রথমবারের মতো অনুভব করছিলাম।


আমার মনে হলো, প্রতিটা জীবনই এক একটা প্যারাশ্যুট জাম্পের মতো। অনিশ্চয়তা থাকে, ভয় থাকে, মনে হয় হয়তো আর খুলবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা আশা, একটা বিশ্বাস, একটা ছোট্ট টান—সেটাই হয়তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। এই মুহূর্তে আমি যেন জীবনকে নতুন করে দেখতে শিখছিলাম। বাঁচা মানে শুধু শ্বাস নেওয়া নয়, বাঁচা মানে প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করা, প্রতিটা চ্যালেঞ্জকে হাসি মুখে গ্রহণ করা।


আমার পা দুটো এখনো একটু কাঁপছিল, তবে সেটা আর ভয়ের কারণে নয়, বরং একটা অদম্য উত্তেজনা আর আনন্দ মেশানো অনুভূতিতে। আমার হাতদুটো আপনাতেই বুকের কাছে চলে গেল, যেন নিজের হৃৎপিণ্ডের ছন্দ অনুভব করতে চাইছিলাম। এই মুহূর্তে আমি জীবিত। আর এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। একটা নীরব হাসি আমার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো। আমি নামছি, আর এই নামাটা এখন আর পতন নয়, এটা একটা নতুন জীবনের দিকে যাত্রা। 

Previous Post Next Post