পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা সম্ভবত অন্য গ্রহ থেকে আসে। তাদের মাথার ভেতরে আলাদা কোনো অপারেটিং সিস্টেম ইনস্টল করা থাকে, যার কারণে তারা সাধারণ মানুষের মতো টেনশন-ফেনশন করে না। অথচ টেনশনই তো মানুষের জীবনকে মসলাদার করে তোলে, তাই না? নাহলে তো জীবনটা পানসে হয়ে যেত। শুধু খাওয়া, ঘুমানো আর বংশবৃদ্ধি! সে তো ছাগল-গরুও করে। মানুষ হিসেবে একটু টেনশন না করলে কি চলে?
কিন্তু কাদের মিয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। কাদের মিয়া এই মুহূর্তে একটা আম খাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। সূর্যটা হেলে পড়েছে পুব থেকে পশ্চিমে, আকাশটা কেমন কমলা রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। বাতাসটা তপ্ত। কাদের মিয়া বসে আছে ফুটপাতের কিনারে, একটা পুরোনো কাঠের টুলে। তার পরনে একটা তালি মারা লুঙ্গি আর ময়লা গেঞ্জি। চুলগুলো উস্কোখুস্কো, পাকা প্রায় সব। লোকটা একটা ফাটাফাটা আম হাতে নিয়ে অতি মনোযোগ দিয়ে খোসা ছাড়াচ্ছে। ছুরিটা একদম ধারালো না। একটু ঘষে ঘষে কাটতে হচ্ছে। কাটার সময় ছুরির ধাতব অংশটা আমের গায়ে হালকা ঘষা খাচ্ছে, একটা মৃদু 'শ্যাঁত শ্যাঁত' শব্দ হচ্ছে। আমের ভেতর থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ উঠে আসছে বাতাসে, চারপাশের ধুলো আর ঘামের গন্ধের সাথে মিশে কেমন অদ্ভুত এক মিশ্র সুবাস তৈরি করছে।
তার ঠিক পাঁচ হাত দূরে দুই রিকশাওয়ালার মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলছে। একজন আরেকজনের প্যাসেঞ্জার নিয়ে কী যেন করেছে। গালিগালাজ চলছে অশ্লীলতম শব্দ ব্যবহার করে। আশপাশের লোক জড়ো হয়ে তামাশা দেখছে। একজন লোক এসে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে, তাকেও ঝাড়ি খাওয়াচ্ছে রিকশাওয়ালারা। মনে হচ্ছে এক্ষুনি হাতাহাতি শুরু হয়ে যাবে। একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জায়গায়। কিন্তু কাদের মিয়ার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার সমস্ত মনোযোগ ওই আমের উপর। সে ধীরে ধীরে খোসা ছাড়াচ্ছে, যেন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খোসা ছাড়ানো শেষ হলে সে আবার ছুরি দিয়েই আমটাকে ফালি ফালি করে কাটবে। আমটা ফজলি আম, বেশ বড়সড়। তার রসালো শরীর থেকে হলুদ আঠালো রস গড়িয়ে পড়ছে হাতের উপর।
কাদের মিয়া চোখ বন্ধ করে একবার লম্বা শ্বাস নিল। আমের মিষ্টি গন্ধটা যেন তার ফুসফুস ভরে দিল। এই টেনশনের পৃথিবীতে সে এক আশ্চর্য নির্লিপ্ত মানুষ। তার কপালে কোনো ভাঁজ নেই, মুখটা একদম শান্ত। কে বলবে দুনিয়াতে এত এত সমস্যা, এত অভাব, এত হতাশা! অথচ ওই রিকশাওয়ালার কথা শুনলে মনে হবে পৃথিবীটা বুঝি এখনই ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের জীবনে আসল টেনশনটা কোথায়, বলুন তো? পেটে ভাত না থাকলে? নাকি সম্মান চলে গেলে? নাকি মনের মানুষটা ছেড়ে চলে গেলে? আসলে, আসল টেনশনটা হলো টেনশন করার অভ্যাসে। কাদের মিয়া হয়তো সেই অভ্যাসটাকেই জয় করে ফেলেছে।
খোসা ছাড়ানো প্রায় শেষ। এবার শুরু হবে আসল পর্ব— আম খাওয়া। কাদের মিয়ার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত তৃপ্তি খেলা করছে, যা দেখে আপনারও মনে হবে, জীবনে এর চেয়ে বড় সুখ বুঝি আর নেই। এই মুহূর্তে, এই আমের জন্য, এই পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ।
- - -
কাদের মিয়া আম খাওয়া শুরু করেছে। ছুরি দিয়ে আমের ফালি কেটে মুখে পুরছে সে, একদম শিশুর মতো। ঠোঁটে লেগে যাচ্ছে আমের রস, নাক ঘেঁষেও অল্প একটু হলুদ আঠালো তরল গড়িয়ে নামছে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমটা মুখে নিয়ে সে চোখ বুজে ফেলছে আবার। টক-মিষ্টি একটা স্বাদ তার জিভে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন জিভের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে সে স্বাদটা অনুভব করছে। আমের আঁশ দাঁতে লাগছে, সে পরম ধৈর্য নিয়ে সেগুলো চিবিয়ে খাচ্ছে। এই পৃথিবীর আর কোনো কিছুর প্রতি তার মন নেই, মন শুধু এই আমটির সাথে মিশে আছে।
পাশের রিকশাওয়ালার ঝগড়াটা এখন হাতাহাতিতে রূপ নিয়েছে। একজন আরেকজনের জামার কলার ধরে ফেলেছে। মারামারি শুরু হওয়ার আগে মাঝখানে যে লোকটি ছিল, সে ভয়ে পিছিয়ে গেছে। ধুলো উড়ছে, মানুষের চিৎকার বাড়ছে। "মার শালাকে! দাঁত ফেলে দে!"— এই ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ বাক্য শোনা যাচ্ছে। আশেপাশে জটলা আরও বেড়েছে। চায়ের দোকানের পাশে বসা একজন বুড়ো লোক, যার হাতে তসবিহ ছিল, সেও উঠে দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি দেখতে। তার কপালের ভাঁজগুলো আরও গভীর হয়েছে, যেন সে সারা পৃথিবীর টেনশন তার একার কাঁধে নিয়ে বসে আছে।
কিন্তু কাদের মিয়া তার মতো। তার এই মুহূর্তে একমাত্র চিন্তা – আমটা যেন শেষ না হয়ে যায়। সে এক টুকরো আম মুখে নিয়ে কিছুক্ষণ গাল ফুলিয়ে রাখলো, যেন মুখের ভেতরেই সে আমটার স্বাদ পুরোপুরি উপভোগ করতে চায়। তারপর গিলে ফেলে আরেক টুকরো কেটে নিল। আমটা সত্যিই সুস্বাদু। ফজলির যে এমন মিষ্টি স্বাদ হতে পারে, তা ভাবাই যায় না। তার মনে হলো, এতক্ষণ ধরে যে টেনশন নিয়ে সে বসে ছিল, সেটা যেন এই আমের মিষ্টি রসে একদম ধুয়ে মুছে গেল। কোনো টেনশন ছিলো নাকি? সে তো ভুলে গেছে। সে তো কেবল একটা আমের কথা মনে রেখেছিলো।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে একজন যুবক, যার নাম মন্টু, সে কাদের মিয়ার দিকে তাকালো। মন্টুর চোখে মুখে বিরক্তি আর টেনশন। সে এই ঝগড়াটা নিয়ে বেশ চিন্তিত, কারণ তার রিকশাটা কাছেই দাঁড়ানো। সে কাদের মিয়াকে দেখে অবাক হলো। "কিরে চাচা, কী আরামসে আম খাইতাছো? দ্যাখো না, কি হইতেছে!" মন্টুর কথায় একটা চাপা অস্থিরতা।
কাদের মিয়া চোখ না খুলেই ফোকলা দাঁতে একটু হাসলো। আমের রস তার ঠোঁটের কোণে চিকচিক করছে। সে খুব শান্ত স্বরে জবাব দিল, "আরে বাবা, মারামারি কি নতুন জিনিস নাকি? আর আমি মারামারি না দেখলে কি তারা মারামারি করবে না?" তার গলাটা কেমন নির্লিপ্ত, যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ সত্যটা বলছে। "জীবনে আম খাওয়ার আনন্দ, সেটা কি মারামারি দেখতে গিয়ে নষ্ট করা যায়?"
মন্টু হতভম্ব। এই লোকের মাথা কি খারাপ? এত বড় একটা ঝগড়া, মারামারি, আর এই লোক কিনা আম খাওয়া নিয়ে দার্শনিক বুলি আওড়াচ্ছে! মন্টু কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কাদের মিয়ার এই নির্লিপ্ততা দেখে তার নিজের টেনশনটাও কেমন ফিকে হয়ে আসছে। মন্টুর মনে হলো, হয়তো কাদের মিয়া ভুল বলেনি। জীবনের অনেক ছোট ছোট আনন্দ, আমরা শুধু বড় বড় টেনশনের পেছনে ছুটতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি। পৃথিবী কি সত্যি সত্যিই এই লোকটার কাছে এতই সহজ? নাকি সে নিজেই নিজেকে এমন একটা সহজ পৃথিবী তৈরি করে নিয়েছে?
- - -
মন্টু কিছুক্ষণ কাদের মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাদের মিয়া তার দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। তার হাত দুটো সমান তালে আম কাটছে আর মুখে পুরছে। মন্টুর মনে হলো, এই লোকটা যেন একটা জ্যান্ত ধাঁধা। দুনিয়ার সমস্ত ঝুটঝামেলা তার সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, অথচ সে নির্বিকার। মন্টুর মনে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন উঁকি দিল। এই লোকটা কি জীবনে কখনো টেনশন করেনি? নাকি এত টেনশন করেছে যে, এখন আর তার অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে?
মন্টু একটু এগিয়ে কাদের মিয়ার কাছে গেল। সে একটা পুরোনো গাছের গোড়ায় বসেছিল। জায়গাটা বেশ ঘিঞ্জি, কিন্তু গাছটার কারণে একটু ছায়া পড়েছে। গাছের পাতাগুলো বাতাসে শিরশির শব্দ করছে। পাতার ফাঁক দিয়ে বিকেলের সোনা রঙা রোদ এসে কাদের মিয়ার উস্কোখুস্কো চুলের উপর পড়েছে, সেগুলোকে আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। গাছের কাণ্ডে কিছু ছোট ছোট পিঁপড়া সারি বেঁধে উপরে উঠছে, তাদের নিজস্ব কাজে তারা ভীষণ ব্যস্ত।
"চাচা, সারাদিন কি এমনই থাকেন?" মন্টু একটু নরম সুরে প্রশ্ন করলো। তার নিজের মনে যে টেনশনের মেঘ জমেছিল, তা যেন কাদের মিয়ার সান্নিধ্যে একটু হলেও কেটে যাচ্ছে।
কাদের মিয়া এবার চোখ খুললো। তার চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে, কিন্তু তার ভেতরে একটা শান্ত গভীরতা। সে মন্টুর দিকে তাকালো। ফোকলা দাঁতে আবারও হাসলো। তার হাসিতে কোনো কৌতুক ছিল না, ছিল এক ধরনের সরলতা। "সারাদিন তো মানুষ কাজ করে বাবা। কাজ না করলে খাবে কী? আর কাজ করলে টেনশন করার সময় কই?"
মন্টু আরও অবাক। "কাজ করলে টেনশন করার সময় কই? এই যে এত অভাব, এত দেনা, এত ঝগড়াঝাঁটি – এইগুলো টেনশন না?" মন্টুর গলাটা একটু উঁচু হলো, যেন সে কাদের মিয়াকে বোঝাতে চাইছে যে পৃথিবীটা আসলে কত কঠিন।
কাদের মিয়া শেষ আমের টুকরোটা মুখে পুরে দিল। তার মুখে লেগে থাকা রসটা হাত দিয়ে মুছে নিল। তারপর চোখ বুজে যেন কিছু ভাবলো। "অভাব তো সবারই আছে বাবা। আমারও আছে। একদিন খাই, দু'দিন না খাই। কিন্তু তাতে কি টেনশন করে শরীর খারাপ করব? যেটুকু আছে, তাতেই খুশি থাকতে শিখলে অভাবটা আর অভাব থাকে না। ওটা তখন নতুন একটা অভিজ্ঞতা হয়।"
কাদের মিয়ার কথাগুলো মন্টুর কানে মন্ত্রের মতো বাজতে লাগলো। সে জীবনে অনেক দার্শনিকদের বুলি শুনেছে, কিন্তু একজন ফুটপাতের ধারে বসে থাকা মানুষ যে এত সহজভাবে জীবনের গভীরতম সত্যগুলো বলে দিতে পারে, তা সে ভাবেনি। মন্টু লক্ষ্য করলো, পাশের রিকশাওয়ালার ঝগড়াটা কেমন কমে এসেছে। হয়তো লোক জড়ো হওয়ায় তারা থামতে বাধ্য হয়েছে। এখন শুধু মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
বাতাসে এবার সন্ধ্যার একটা শীতল পরশ লাগতে শুরু করেছে। দিনটা কেমন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মন্টুর মনে হলো, সে আজ এমন কিছু শিখেছে যা কোনো বই পড়ে বা কোনো বড় মানুষ থেকে শেখা সম্ভব ছিল না। সে শুধু দেখলো একজন মানুষ কীভাবে নির্লিপ্ততার চাদরে নিজেকে ঢেকে রেখে পৃথিবীর যাবতীয় টেনশনকে পাশ কাটিয়ে জীবনকে উপভোগ করে। কাদের মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মন্টুর হঠাৎ মনে হলো, সম্ভবত এই লোকটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
