স্বপ্নচ্ছায়া



রাত্রির ঘুম জুড়ে আমাদের মনের অগত্যাচ্ছেদ্য প্রান্তরে অবচেতন ঘনায় অদ্ভুত এক আঙিনা গড়ে ওঠে- সেখানেই আবির্ভূত হয় স্বপ্ন, যেন আলো ও ছায়ার এক মৃদু গল্প। স্বপ্ন কি মস্তিষ্কের যান্ত্রিক আবর্তন? না, বরং অবচেতনের ভেতরের এক গোপন বাগান, যেখানে আলো-ছায়া মিশে তৈরি করে অদ্ভুত এক অনুভূতি। 

আমরা যেটাকে স্বপ্ন বলি, তা কি কেবল মস্তিষ্কের অস্থির খেয়াল, নাকি এক ধরনের সূক্ষ্ম বার্তা- আলোকের ছায়া, যা আমাদের গভীরতম অনুভূতিকে স্পর্শ করে? স্বপ্ন কি কেবল দৈহিক ক্লান্তির প্রোডাক্ট? নাকি এর ভেতরে আল্লাহর রহমতের কিছু ইশারা লুকিয়ে আছে?

স্বপ্নে পথ হারানো মানে পথে খুঁজে পাওয়া। সেখানকার চিত্রগুলো কখনো কারো মুখের আদল বলে যায়, কখনো পরিচিত কোনো স্থানকে অদ্ভুত রূপে সাজায়। যেন অবচেতন আমাদের কাছে খুলে দেয় তার মনের দরজা, যেখানে দিনের আড়ালিত আকাঙ্ক্ষা, ভয়ের দোলাচল, আর অপ্রকাশ্য আশা- সব মিলেমিশে এক নতুন আকার নেয়। 

স্বপ্ন আমাদের হদিস দেয় জীবনের লুকানো ইচ্ছে আর ভীতিকে। কখনো ভেসে ওঠে শৈশবের আনন্দ, কখনো জাগ্রত জীবনের অনিশ্চয়তা। সেই দৃশ্যপটে আমরা দেখে যাই- কোনো পুরোনো স্মৃতি, কোনো অসমাপ্ত সাহসিকতা, কিংবা কোনো অদেখা ভবিষ্যতের রঙ। 

স্বপ্নে আমরা নিয়মে বাঁধা পড়ি না; আমরা হেঁটে যাই অবচেতনের পথে, যেখানে সময় নিজে দাঁড়িয়ে, অপেক্ষা করছে আমাদের যখনই পৌঁছাবো তার ছায়াময় দ্বারে। স্বপ্ন আমাদের সেই অনুভবগুলোর রূপ- যেগুলো আমরা দিনের আলোয় বুঝতে পারি না। ভয়ের যে শিকড় আমাদের ভিতর জমে থাকে, না বলা কষ্ট, অথবা সুপ্ত ইচ্ছাগুলো- সব এক এক করে বেরিয়ে আসে অবচেতনের প্রান্তরে। আসলে স্বপ্ন মানে, মন যখন কথা বলে- শব্দ ছাড়াই।

প্রিয় কারো হাসি, যেটি দিনের আলোয় দেখা যায় না, রাতের অন্ধকারে ভেসে ওঠে আলোর মতো স্বচ্ছ। কোনো পদচিহ্ন, যা কখনো আমরা হাঁটিনি, কিন্তু স্বপ্নে যেন আমাদেরই পথচিহ্ন। সেই পথটাই হয় আত্মার দোলা- যেখানে আল্লাহর নিঃশব্দ ডাকও কখনো প্রতিধ্বনিত হয় গোলাপি আকাশের আড়ালে। স্বপ্নের মাঝখানে আমরা এক আলো আর অন্ধকারের মিশ্র বাতাসে হারিয়ে যাই। সেখানে শব্দ কঠিন হয়ে গেলেও পরিবেশ মেলোডি হয়ে ওঠে; আবেগ হয় মুক্ত, সীমাবদ্ধতা ভেঙে ফেলে সব বেড়াজাল। যেখানে আকাশে উড়ে বেড়ানো যায়, পানিতে মাছের মত ঘুরে বেড়ানো যায়।

স্বপ্ন কখনো সমাধি, কখনো বিপ্লব। সময় থেমে যায়; কারণ সেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত একত্রিত হয়। আমরা স্বপ্নে হারাই, আবার খুঁজে পাই, যেন জীবনের প্রতিটি স্তরে জেগে থাকার এক সরল সূত্র- যা সারা দিনের মানসিক বলপূর্ব পারিপার্শ্বিক চাপ থেকে মুক্ত করে, মনের এক বিশুদ্ধ ক্যানভাস খুলে দেয়। কখনো ভয়, কখনো শান্তি; কখনো কান্নার আভাস, আবার কোমল আলোয় ভরা ব্যথার রং। সব মিলিয়ে, স্বপ্নের আঙিনায় আমরা পাই আত্মার সুখ্যাতি- নীরব আলো আর ছায়ার মিথস্ক্রিয়া, যা দিনের চোখে দৃশ্যমান হয় না, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে এক অমৃত স্পর্শ ফেলে যায়।

কিছু স্বপ্ন ভুলে যাই ঠিক ভোরেই। কিছু স্বপ্ন মনে গেঁথে থাকে বছরের পর বছর। কিছু স্বপ্ন শুধু দেখে যাই, কিছু স্বপ্নে আমরা অনুভব করি। তবে সব স্বপ্নই যেন নিজের ছায়ার মতো- কিছুটা কাছের, কিছুটা দূরের। আর যখন ভোরে ঘুম ভাঙে, সেই এক ঝলক স্বপ্ন আস্তে আস্তে মুছে যায় মনের প্রান্তরে- কিন্তু তার প্রতিধ্বনি থাকে হৃদয়ে, ওঠে নতুন উপলব্ধির প্রত্যয়।

আমাদের নবী (সা.) বলেছেন, শেষ যুগে মুমিনের স্বপ্ন মিথ্যা হবে না। অর্থাৎ সত্যিকারের স্বচ্ছ হৃদয়ই পারে স্পষ্ট স্বপ্ন দেখতে। তাই স্বপ্নও এক আত্মিক আয়না- যেখানে আমরা আমাদের ঈমানের ছায়া দেখি, আশা আর ভয় দেখি, আর মাঝে মাঝে দেখি এমন কিছু, যা আমাদের জাগ্রত অবস্থাতেও আলো দেখায়। স্বপ্ন মানুষকে থামিয়ে দেয়, ভাবায়। কখনো ভয় দেখায়, কখনো আশ্বাস দেয়। আর কখনো তা হয় এক অন্তর্জাগতিক ডাক- যা বলে, “তুমি শুধু এই দেহ নও; তোমার ভিতরে আরও অনেক গভীর কিছু চলছে।”

স্বপ্ন যদি আলোর ছায়া হয়, তবে আমরা সেই ছায়ার খোঁজে যেতে পারি- অবচেতন থেকে সচেতন রূপান্তরের পথে। আমাদের জাগ্রত মন যদিও অনেক সময় ছায়ায় ঢেকে যায়, স্বপ্ন আমাদের দেখায় সেই আলোর দিশা, যেখানে ঘুম-জাগরণের সীমানা মিলেমিশে ঘটে এক অবরুদ্ধ মুক্তি। আমরা শুধু এই জাগ্রত পৃথিবীর বাসিন্দা নই। আমাদের ভিতরে আছে আরও একটি আঙিনা, যেখানে আলোও আছে, ছায়াও আছে- আর তারই নাম স্বপ্ন। 

Previous Post Next Post