রাশেদ সাহেবের কাজটা অদ্ভুত। তিনি মানুষের স্বপ্ন ভাড়া শোনেন। পেশাদার স্বপ্ন-শ্রোতা। ভাড়া ভালোই পান। তার বসার ঘরটা গাঢ় সবুজ রঙের। বিজ্ঞানীরা বলেন সবুজ রঙ চোখের জন্যে ভালো, মন শান্ত রাখে। রাশেদ সাহেব বিজ্ঞানীদের কথা শোনেননি, তার এই রঙটা ভালো লাগে, তাই সবুজ করেছেন।
আজকের মক্কেল একজন ভার্সিটির তরুণী। নাম নীলা। সে খুব নিচু গলায় কথা বলছে। "শহরটা পুরো জলরঙে আঁকা। বুঝলেন?"
রাশেদ সাহেব তার খসখস করে নোটবুকের পাতায় লিখলেন—'জলরঙ'।
"বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু রঙ ধুয়ে যাচ্ছে না। বরং আরও উজ্জ্বল হচ্ছে।"
"শহরে মানুষ আছে?"
"আছে। কিন্তু তাদের মুখ নেই। মসৃণ চামড়া।"
"তারা কথা বলে?"
"না। ইশারায়। সবাই একটা সবুজ নদীর দিকে তাকিয়ে হাসে।"
রাশেদ সাহেব কলমটা নামিয়ে রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন, "আপনি এই নিয়ে ছয় নম্বর।"
নীলা ভুরু কোঁচকালো। "ছয় নম্বর কী?"
"এই স্বপ্নটা যে দেখছে। হুবহু।" নীলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
"গতকাল একজন রিকশাচালক এসেছিলেন। নাম কালাম। তিনিও এই জলছবির শহরের স্বপ্ন দেখেছেন। তার ভাষ্যমতে, সেই শহরের বাতাসে পোলাওয়ের গন্ধ।"
নীলা অবাক হয়ে বলল, "হ্যাঁ! ঠিক! পোলাওয়ের গন্ধ। আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম!"
রাশেদ সাহেব তার নোটবুকটা এগিয়ে দিলেন।
"পড়ুন।" নীলা পড়তে লাগল।
মোট পাঁচজনের স্বপ্নের বিবরণ। একজন স্কুল মাস্টারের, একজন গৃহবধূর, একজন পুলিশ কনস্টেবলের, সেই রিকশাচালকের, আর একজন অল্পবয়সী পকেটমারের। সবার স্বপ্ন এক। জলরঙে আঁকা শহর। মুখহীন মানুষ। বৃষ্টিতে উজ্জ্বল হওয়া রঙ। সবুজ নদী। আর বাতাসে পোলাওয়ের গন্ধ।
মানুষের অবচেতন মন ভারি অদ্ভুত এক জায়গা। এখানে পদার্থবিদ্যার কোনো সূত্র খাটে না। একটা পিঁপড়ে কথা বলতে পারে, মৃত মানুষ ফিরে এসে চা চাইতে পারে। কিন্তু যখন সম্পূর্ণ আলাদা পাঁচ-ছয়জন মানুষের অবচেতন এক বিন্দুতে মিলিত হয়, তখন ব্যাপারটা আর অদ্ভুত থাকে না। ভয়ের হয়ে দাঁড়ায়।
রাশেদ সাহেব বললেন, "আপনাদের মধ্যে কোনো মিল আছে?"
"কীসের মিল?"
"আপনারা সবাই কি একই সিনেমা দেখেছেন? বা একই বই পড়েছেন?"
"না তো। আমি কালাম নামের কাউকে চিনি না। পকেটমারের সাথেও আমার পরিচয় থাকার কথা নয়।"
নীলা চলে যাবার পর রাশেদ সাহেব সবুজ ঘরটায় একা বসে রইলেন। নোটবুকটা খোলা। এই ছয়জন মানুষের মধ্যে যোগসূত্রটা কী? তারা সবাই ঢাকায় থাকে। এটুকুই। ঢাকা শহরের পাঁচ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ছয়জন একই স্বপ্ন দেখছে? নাকি আরও অনেকে দেখছে, কিন্তু তারা স্বপ্ন-শ্রোতা রাশেদ সাহেবের কাছে আসছে না?
রাশেদ সাহেবের একটা অভ্যাস আছে। তিনি দুপুরে ঘুমান না। কিন্তু আজ তার চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল। সবুজ সোফাটায় তিনি গা এলিয়ে দিলেন।
ঘুমের ভেতরে তিনি নিজেকে একটা শহরে আবিষ্কার করলেন। চারপাশ ভেজা। বাতাসটা স্যাঁতসেঁতে। আর নাকে আসছে পোলাওয়ের তীব্র ঘ্রাণ। তিনি দেখলেন, একটা জলরঙে আঁকা বাড়ির বারান্দায় একজন রিকশাচালক আর একজন ভার্সিটির তরুণী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কোনো মুখ নেই। তারা ইশারায় রাশেদ সাহেবকে ডাকল। তাদের ইশারার অর্থ- "আসুন। সবুজ নদীটা ঐদিকে।"
