"হ্যালো?"
"কে?"
"আমি।"
"আমি কে?"
"আমি আসিফ।"
"মিথ্যা কথা," ফোনের ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ, কাচের মতো স্বচ্ছ একটা গলা উত্তর দিলো। "আসিফ তো আমি।"
আমি কপাল থেকে ঘাম মুছলাম। বসার ঘরের সোফাটায় আমি কাঠ হয়ে বসে আছি। আমার হাতে ধরা রিসিভারটা অদ্ভুত ভারী। জিনিসটা ব্যাকেলাইটের। পুরানো, কালো, আর ওজনদার। এই ফোন আমি আমার দাদার পুরানো ট্রাঙ্ক থেকে পেয়েছি। এতে কোনো তার নেই। কোনো লাইন নেই। এটাতে কোনোভাবেই রিং বেজে ওঠা সম্ভব না।
তবু বেজেছিলো।
"শোনো," আমি বললাম, আমার গলা ধরে আসছিলো। "তোমার বয়স কত?"
ওপাশ থেকে ছেলেটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। "বোকা নাকি? আমার বয়স পাঁচ। আমি কালকে ঝিনুক দিয়ে একটা খরগোশ বানিয়েছি। তুমিও বানাতে পারো?"
আমার বুকের ভেতর একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, পাঁচ বছর বয়সে আমি একটা ভাঙা ঝিনুক দিয়ে খুব বাজে দেখতে একটা খরগোশ বানিয়েছিলাম।
"তোমার নাম ছোটন, তাই না?"
"হ্যাঁ। তোমাকে কে বললো?"
"আমি জানি।"
"তুমি পচা লোক। তুমি আমার নাম জানলে কী করে?"
আমি কী করে বোঝাই? আমি এখন আটত্রিশ বছরের আসিফ। আমার মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, আর আমার পৃথিবীটা আশ্চর্যরকম বিবর্ণ।
"ছোটন," আমি মরিয়া হয়ে বললাম। "আমগাছটা থেকে সাবধানে থেকো।"
"কোন আমগাছ?"
"পুকুরপাড়ের ওই বড়োটা। ওটাতে চড়তে গিয়ে তুমি পড়ে যাবে। ডান হাত ভাঙবে।"
ওপাশের শিশুটা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। রিসিভারের ভেতর দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ আসছিলো। ঠিক স্ট্যাটিক নয়, কেমন যেন একটা ফাঁকা মহাবিশ্বে বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ। যেন কোনো সুদূর নীহারিকার বুকচিরে আসা দীর্ঘশ্বাস।
"তুমি পড়ে গিয়েছিলে?" ছোটনের গলার স্বরটা হঠাৎ করেই গভীর, যেন সে পাঁচ বছরের শিশু নয়, যেন সে সবজান্তা।
"হ্যাঁ," আমি ফিসফিস করে বললাম।
"ব্যথা পেয়েছিলে?"
"অনেক।"
"এখনো ব্যথা?"
আমি চমকে উঠলাম। এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমার ভাঙা হাত কবেই জোড়া লেগে গেছে, কিন্তু এই আটত্রিশ বছর বয়সী আসিফের ভেতরের ব্যথাটা কি এখনো যায়নি?
"শোনো ছোটন," আমি বললাম। "আরেকটা কথা। বাবাকে খুব বেশি জ্বালিয়ো না। মা'র যত্ন নিয়ো। আর..."
আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম? মন দিয়ে পড়তে? ভালো মানুষ হতে? ওই কথাগুলোর কোনো মানে হয় না।
"তুমি কাঁদছো?" ছোটন জিজ্ঞেস করলো।
"না।"
" কাঁদছো। তোমার গলা ভেজা।"
"ফোনটা পেয়েছো কোথায়?" আমি প্রসঙ্গ ঘোরালাম।
"এটা তো একটা খেলনা। বাবা বাজার থেকে এনেছে। কালো রঙের। খুব সুন্দর।"
আমার হাত কাঁপছিলো। আমি ফোনটার দিকে তাকালাম। এটা খেলনা নয়। এটা একটা অসম্ভব। একটা টাইম মেশিনের চেয়েও জটিল, একটা স্বপ্নের চেয়েও ভঙ্গুর। এই সংযোগটা যেকোনো মুহূর্তে কেটে যেতে পারে।
"ছোটন," আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম। "আমার কী করা উচিত?"
"কীসের কী করা উচিত?"
"জীবনে। বেঁচে থাকতে। আমার খুব কষ্ট।"
ওপাশে আবার সেই অদ্ভুত নীরবতা। তারপর ছোটনের সেই কাচের মতো গলাটা বললো, "খেলনা দিয়ে খেলো।"
"কী?"
"আমার ঝিনুকের খরগোশটা খুব সুন্দর। আমি ওটা নিয়ে খেলি। তুমিও খেলো।"
"আমার কোনো খেলনা নেই, ছোটন।"
"তাহলে কিনে নাও।"
আমার ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। এই শিশুটা একটা দানব। সে সত্যিকে একটা ধারালো ছুরির মতো ব্যবহার করতে পারে। তার কাছে কোনো জটিলতা নেই।
"আসিফ," ছোটন ডাকলো।
"বলো।"
"তুমি সাবধানে থেকো।"
"কোথা থেকে?"
"পড়ে যেয়ো না।"
আমি কিছু বলার আগেই ওপাশে একটা ক্লিক শব্দ হলো। লাইনটা কেটে গেছে।
আমি ভারী, কালো রিসিভারটা কানে চেপে ধরে বসে রইলাম। ঘরের ভেতর অদ্ভুত স্তব্ধতা। বাইরে একটা কাক ডেকে উঠলো। আমি জানি এই ফোন আর কখনো বাজবে না।
কিন্তু পাঁচ বছরের আমি, আটত্রিশ বছরের আমাকে একটা সতর্কবার্তা দিয়ে গেলো।
"পড়ে যেয়ো না।"
আমগাছ থেকে নয়। জীবন থেকে।
