আবুল মিয়া আজ অনেক দিন পর একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলেন। তিনি একটা চায়ের দোকানে বসে আছেন। চারপাশটা গিজগিজ করছে মানুষে। সবাই ব্যস্ত। রিকশার টুংটাং শব্দ, মানুষের জটলা পাকানো কথা। তার হঠাৎ কেমন জানি অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো।
এই অস্বস্তিটা ঠিক কোত্থেকে আসে? বুকের ভেতরটা কেমন গুরগুর করছে, মাথাটা একটু ভারভার। কোনো কারণ নেই তো! সকালবেলা ভালোমতো ভাত খেয়ে বেরিয়েছেন। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়াও হয়নি। তাহলে কেন এমন লাগছে? তার মনটা কেমন জানি তেতো হয়ে আছে, যেন কেউ জোর করে টক কিছু খাইয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ তার মনে হলো, এই যে অস্বস্তি, বিরক্তি – এই সব কি তার ব্রেন তৈরি করছে না? ব্রেন কি একটা যন্ত্রের মতো? আর তিনি কি সেই যন্ত্রের ড্রাইভার? ব্যাপারটা ভেবে তার হাসি পেল। তিনি তো জীবনে অনেক কিছু চালিয়েছেন – রিকশা চালিয়েছেন, একবার একটা ভাড়ার মাইক্রোবাসও চালিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রেন নামের এই জটিল যন্ত্রটা যে তার হাতেই, এটা তিনি ভাবেননি কোনোদিন।
তিনি চোখ বন্ধ করলেন। মনে মনে বললেন, 'ব্রেন, তোমার এই অস্বস্তির প্রোগ্রামটা বন্ধ করো। আমি এখন শান্তি চাই। একটা তাজা ফুলের ঘ্রাণ চাই। এক কাপ গরম চায়ের তৃপ্তি চাই।'
এক সেকেন্ড, দু'সেকেন্ড… আবুল মিয়া অবাক হয়ে দেখলেন, বুকের গুরগুরানিটা একটু কমেছে। মাথার ভারভাবটা একদমই চলে গেছে। আর অদ্ভুত ব্যাপার, তার নাকের ভেতর যেন সত্যিই একটা বেলি ফুলের হালকা সুগন্ধ এসে লাগলো। চারপাশে তো বেলি ফুলের গাছ নেই। কেবল চা আর সিগারেটের গন্ধ। তাও কীভাবে এই সুগন্ধটা এলো?
এটা কি সত্যি? নাকি তিনি নিজেকে ধোঁকা দিচ্ছেন? ব্রেন কি সত্যিই তার কথা শুনছে? একটা ভয়ংকর ক্ষমতা লুকিয়ে আছে তার মাথার ভেতরে, যা নিয়ে তিনি এতদিন কোনোদিন মাথা ঘামাননি? ব্যাপারটা ভেবে তার শরীরটা শিউরে উঠলো।
আবুল মিয়ার হাতে ধরা চায়ের কাপটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তিনি চোখ মেলে তাকালেন। তার মনে হলো, সামনে বিরাট একটা রাস্তা খুলে গেছে তার জন্য। এই রাস্তা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়? তিনি জানেন না। তবে পথটা নিশ্চয়ই খুব মজার হবে।
আবুল মিয়া চায়ের দোকানের বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তার সামনে গ্লাসটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। চা খাওয়া বাদ দিয়ে তিনি এখন একটা অদ্ভুত খেলা খেলছেন নিজের ব্রেনের সাথে। প্রথমবার একটা অস্বস্তি দূর করে বেলি ফুলের গন্ধ আনতে পেরেছিলেন। এটা কি কাকতালীয় ছিল? নাকি সত্যি সত্যিই তার ব্রেন কথা শুনছে?
তিনি নিজেকে বললেন, "ব্রেন, তুমি কি আমার কথা আসলেই শোনো? শোনো তো, তাহলে এবার আমাকে দারুণ খুশি করে দাও। এমন খুশি, যেন আমি লটারি জিতেছি, বা বিদেশ থেকে আমার বড় ভাই অনেক টাকা পাঠিয়েছে। অকারণ খুশি।"
তিনি চোখ বন্ধ করলেন আবার। গভীরভাবে শ্বাস নিলেন। তার মনে হলো, মাথার ভেতরের কোষগুলো যেন তার কথা শুনছে। একটা ছোট্ট সুইচ অন করার মতো। ধীরে ধীরে তার বুকের ভেতরটা কেমন হালকা লাগতে শুরু করলো। একটা মিষ্টি অনুভূতি চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরছে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। অকারণে হাসি।
পাশের লোকটা তাকে তাকিয়ে দেখলো। "কি ব্যাপার আবুল ভাই? আজ কি কোনো সুসংবাদ আছে নাকি? দাত কেলিয়ে হাসছেন যে?"
আবুল মিয়া হাসতে হাসতেই বললেন, "না ভাই, তেমন কিছু না। এমনিতেই ভালো লাগছে।"
কিন্তু তিনি জানেন, এটা 'এমনিতেই ভালো লাগা' নয়। এটা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আকাশটা যেন আরও নীল দেখাচ্ছে, রিকশার টুংটাং শব্দটাও এখন বিরক্তিকর লাগছে না, বরং একটা ছন্দের মতো মনে হচ্ছে। এমনকি চায়ের দোকানের ভাজা পেঁয়াজির গন্ধটাও আজ মনকাড়া।
তিনি ভাবলেন, এতোদিন ধরে মানুষ সুখের পেছনে দৌড়ায়। কত কসরত করে, কত পরিশ্রম করে। আর তিনি কিনা শুধু মনে মনে একটা নির্দেশ দিয়েই এই সুখটা তৈরি করতে পারলেন! এটা কি জাদুর মতো কিছু? তিনি কি কোনো জাদুকর হয়ে গেলেন?
যদি তিনি নিজের মনকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে কি তিনি অন্যের মনকেও প্রভাবিত করতে পারবেন? নাকি শুধুই নিজের ব্রেনের ওপর তার এই ক্ষমতা? প্রশ্নটা তার মনে উঁকি দিতেই তার মুখের হাসিটা সামান্য কমে গেল। এটা তো কেবল শুরু। আসল খেলাটা হয়তো এখনও শুরুই হয়নি। তিনি আরেকবার গভীরভাবে শ্বাস নিলেন। এবার কী করা যায়? একটা দীর্ঘশ্বাস। হোক না, তিনি তো নিজেই এর উত্তর বের করবেন।
আবুল মিয়া ভাবলেন, সুখ তৈরি করা গেলো, অস্বস্তি দূর করা গেলো। ফুলের গন্ধও পাওয়া গেলো। সবই তো ভালো। কিন্তু এটা কি শুধু অনুভূতির ব্যাপার? মানে, যা অনুভব করা যায়? নাকি এর চেয়েও বেশি কিছু করা সম্ভব?
তিনি আরেকবার চায়ের দোকানের বেঞ্চে সোজা হয়ে বসলেন। তার চোখ দুটি কিছুটা চঞ্চল। পাশের লোকটা এখনও তাকে দেখছে, যেন আবুল মিয়া কোনো চিড়িয়াখানার বিরল প্রাণী। আবুল মিয়ার তাতে কিছু যায় আসে না।
তিনি মনে মনে নিজেকে বললেন, "আচ্ছা ব্রেন, তুমি তো এত কিছু করতে পারো। এখন দেখি তো, তুমি আমার হাতটাকে বাতাসে ভাসাতে পারো কিনা।"
কথাটা বলার সাথে সাথেই তার ভেতরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠলো। এটা কি সম্ভব? মানুষ কি হাত ভাসাতে পারে? পারে না তো! মাধ্যাকর্ষণ বলে একটা জিনিস আছে না?
তিনি তার ডান হাতটা সামনের দিকে বাড়ালেন। মনে মনে বললেন, "ওঠো, হাত। শূন্যে ওঠো।"
কোনো কাজ হলো না। হাতটা আগের মতোই ভারী। চেয়ারের হাতলে আলতো করে রাখা। আবুল মিয়া হতাশ হলেন। তাহলে কি তার ক্ষমতা কেবল অনুভূতি তৈরি করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ? শারীরিক কোনো পরিবর্তন কি তিনি ঘটাতে পারবেন না? তার ভেতরটা কেমন জানি চুপসে গেল।
কিন্তু হঠাৎ তার মনে হলো, তিনি তো 'শূন্যে ওঠো' বলেছেন। ব্রেন কি তার এই কথাটাকে সরাসরি নিয়েছে? তার তো কোনো 'পেশী নড়াও', 'শক্তি দাও' – এমন কিছু বলেননি। হয়তো ব্রেন শুধু তার কথার আক্ষরিক অর্থটাই বোঝে।
তিনি আবার চোখ বন্ধ করলেন। এবার আরও মনোযোগ দিয়ে, একদম নিখুঁত নির্দেশ দিতে হবে। তিনি মনে মনে বললেন, "আমার ডান হাতের প্রত্যেকটা পেশী শিথিল হোক। কিন্তু সেগুলো যেন এমনভাবে শিথিল হয়, যেন হাতটা পালকের মতো হালকা হয়ে যায়। কোনো ভার না থাকে। আর ধীরে ধীরে, খুব ধীরে ধীরে, হাতটা যেন উপরের দিকে উঠে আসে।"
এবার একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটলো। তার হাতের আঙ্গুলগুলো কেমন জানি হালকা হয়ে গেল। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন ভেতর থেকে তার হাতটাকে ঠেলে তুলছে। একদম ধীরে ধীরে, খুব সামান্যই উপরে উঠলো। এক ইঞ্চি? আধা ইঞ্চি?
তার চোখ কপালে উঠলো। অবিশ্বাস্য! হাতটা সত্যিই শূন্যে ভেসে আছে। খুব সামান্যই, কিন্তু ভেসে আছে তো! তিনি হাতটা ছেড়ে দিলেন না। যেন একটু জোরে নিঃশ্বাস ফেললেই হাতটা আবার পড়ে যাবে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হতে শুরু করলো।
এটা কিভাবে সম্ভব? তিনি তো কোনো জাদু করেননি। কেবল নির্দেশ দিয়েছেন। এই ব্রেনটা তো তার শরীরকেই নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে কেন পারবে না? এত সাধারণ একটা জিনিস, অথচ এতদিন তিনি এর বিন্দুবিসর্গও জানতেন না।
পাশের লোকটা হঠাৎ বলে উঠলো, "আবুল ভাই, আপনার হাতে কি ব্যথা পেলেন নাকি? এমন করে আছেন কেন?"
আবুল মিয়া হাসলেন। এক বিজয়ের হাসি। "না ভাই, একটু খেলা করছিলাম নিজের সাথেই।"
লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আবুল মিয়া তার ভাসমান হাতটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এবার এই হাত দিয়ে কী করা যায়? মনে হচ্ছে, তিনি নিজেই নিজের ব্রেনের একজন শিক্ষানবিশ বিজ্ঞানী।
আবুল মিয়া তার ভাসমান হাতটা ধীরে ধীরে নামালেন। এবার আর কোনো নির্দেশ দেওয়ার দরকার পড়লো না, হাতটা নিজেই নেমে এলো। কেমন জানি দুর্বল লাগছে তার হাতটা। ঠিক যেন অনেকক্ষণ ভারি কিছু তুলে রাখার পর যে ক্লান্তি আসে, তেমনই। তাহলে ব্রেনকে নির্দেশ দিলে শরীর শক্তিও খরচ করে। এটা নতুন একটা তথ্য।
তিনি ভাবলেন, এতোক্ষণ ধরে তিনি যে কাজগুলো করছিলেন, সেগুলো কি তার ব্রেনের স্বাভাবিক কার্যকলাপের বাইরে? নাকি ব্রেন নিজেই নিজেকে নতুন করে চিনছে? তার মনে হলো, ব্রেন একটা নতুন খেলনা পেয়েছে, আর তিনি সেই খেলনার প্রথম ব্যবহারকারী।
এই হাত ভাসানোর ব্যাপারটা নিয়ে তিনি আরেকটু ভাবতে শুরু করলেন। যদি হাত ভাসানো যায়, তাহলে কি অন্য কোনো অঙ্গও ভাসানো যাবে? নাকি পুরো শরীর? ব্যাপারটা ভেবেই তার গা ছমছম করে উঠলো। তিনি যদি শূন্যে ভেসে বেড়াতে পারেন! তাহলে তো তিনি সুপারম্যান হয়ে যাবেন!
কিন্তু তার মনে হলো, এখনই এত বড় লাফ দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আগে ছোট ছোট জিনিসগুলো ভালো করে বুঝতে হবে। তিনি চারপাশে তাকালেন। চায়ের দোকানে তখনও লোকজন গিজগিজ করছে। তাদের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, এই লোকগুলো যদি জানতো, তাদের মাথার ভেতরে কী ভয়ঙ্কর ক্ষমতা লুকিয়ে আছে, তাহলে কী হতো? হয়তো পৃথিবীটা আরও অদ্ভুত হয়ে উঠতো।
হঠাৎ তার মনে পড়লো তার পুরনো একটা ব্যথার কথা। তার ডান হাঁটুর ঠিক নিচে একটা পুরনো ব্যথা আছে, যখন রিকশা চালাতেন তখন একবার পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন। শীতে ব্যথাটা বাড়ে। আজ সকালেও একটু টিসটিস করছিল।
তিনি ভাবলেন, ব্রেনকে দিয়ে কি এই ব্যথাটা কমানো যাবে? তিনি তো ব্যথা অনুভব করছেন, আর এই অনুভূতি তো ব্রেনেরই কাজ। যদি সুখ তৈরি করা যায়, তাহলে ব্যথা দূর করা যাবে না কেন?
তিনি চোখ বন্ধ করলেন। ডান হাতটা তার হাঁটুর ওপর রাখলেন। মনে মনে বললেন, "ব্রেন, আমার ডান হাঁটুর এই পুরনো ব্যথাটা যেন একদম চলে যায়। ব্যথা সৃষ্টিকারী সব অনুভূতি যেন বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে যেন শুধু আরাম আর শান্ত একটা অনুভূতি থাকে।"
প্রথমে কিছুই হলো না। ব্যথাটা আগের মতোই টিসটিস করছে। আবুল মিয়া হতাশ হলেন। হয়তো সুখ আর ব্যথার ব্যাপারটা একরকম নয়। সুখ তৈরি করা সহজ, কিন্তু একটা শারীরিক ক্ষত সারানোটা হয়তো ব্রেনের ক্ষমতার বাইরে।
কিন্তু তিনি সহজে হার মানার পাত্র নন। তিনি আবারও চেষ্টা করলেন। এবার তিনি আরও সূক্ষ্মভাবে ভাবলেন। "ব্রেন, আমার ডান হাঁটুর যেখানে ব্যথা হচ্ছে, সেখানকার স্নায়ুগুলো শান্ত হোক। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হোক। আর ব্যথার যে সংকেত, সেটা যেন আমার মস্তিষ্কে আর না পৌঁছায়।"
এইবার একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটলো। প্রথমে একটা হালকা গরম অনুভব করলেন তিনি তার হাঁটুতে। তারপর সেই টিসটিস করা ব্যথাটা ধীরে ধীরে হালকা হতে লাগলো। একদম ধীরে ধীরে, যেন কেউ একটা পুরনো মরচে ধরা কলম দিয়ে লিখছে, আর সেই কালিটা শুকিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত ব্যথাটা সত্যিই উধাও হয়ে গেল!
আবুল মিয়া তার হাঁটুর ওপর থেকে হাত সরালেন। তিনি অনুভব করলেন, একটা আরামদায়ক অনুভূতি সেখানে। যেন কোনো ম্যাজিক হয়ে গেছে। তার চোখ খুলে গেল। তিনি নিজের দিকে তাকালেন। এই কাজটা করতে গিয়ে তার কপালে হালকা ঘাম জমেছে।
তার মনে হলো, এতদিন তিনি যে শরীরটাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সেটাকে তিনি চিনতেন না। এটা যেন একটা বিশাল লাইব্রেরি, আর তিনি এতদিন কেবল বইয়ের মলাটটা দেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন। এখন তিনি বইয়ের ভেতরে ডুব দিতে শিখেছেন। এই লাইব্রেরির শেষ কোথায়? তিনি জানেন না। কিন্তু এই যাত্রাটা দারুণ মজার হবে, তিনি নিশ্চিত।
