মতিনের যান্ত্রিক পৃথিবী





আজকাল গরমটা কেন যেন অন্যরকম লাগে। আগে যে গরম পড়তো, তাতে একটা কাদা কাদা গন্ধ থাকতো, মাটির ঘাম। এখনকার গরমে তেমন কিছু নেই। কেমন যেন শুকনো, রুক্ষ একটা তাপ। মনে হয় যেন বাতাসটাকেই কেউ সেঁকে দিয়েছে, একদম রসকষহীন। শরীর থেকে ঘাম বের হয় না, শুধু ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। তৃষ্ণাটা এমন চড়চড় করে বাড়ে যে মনে হয়, গলাটা বুঝি বালি দিয়ে ভরে গেছে। জানালার কাঁচগুলোও আজকাল বড় পাতলা হয়ে গেছে। সামান্য শব্দেই যেন থরথর করে কাঁপে, মনে হয় এখনই বুঝি ভেঙে টুকরো টুকরো হবে। আমি সেই কাঁচের ওপাশ থেকে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। রাস্তাটা চিকচিক করছে। পিচ ঢালা পথ। কিন্তু এখন আর পিচ ঢেলে রাস্তা বানায় না। কী যেন একটা ধূসর রঙের মসৃণ জিনিস দিয়ে বানায়, রোদ পড়লে চকচক করে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মনে হয়, এখনই বুঝি রাস্তা গলে যাবে, ঠিক গলিত রূপার মতো। দূরে একটা ড্রোনের ভনভন শব্দ ভেসে আসছিল। এক সময় কবুতরের বাকবাকুম শব্দ শোনা যেতো, চড়ুই পাখির কিচিরমিচির। এখন সেই শব্দ নেই। এখন শুধু ড্রোন। ছোট ছোট উড়ন্ত যন্ত্র। মালপত্র নিয়ে যায়, খাবারের প্যাকেট দেয়, এমনকি জরুরি চিঠিপত্রও পৌঁছে দেয়। মানুষ এখন হাঁটাচলায় আর বিশ্বাসী না। হেঁটে গেলে নাকি সময় নষ্ট হয়, শক্তি ক্ষয় হয়। এই শহরের বাতাসও এখন কেমন যেন ধাতব গন্ধ মেশানো। আগে বৃষ্টির পর মাটির একটা সোঁদা গন্ধ উঠতো, এখন বৃষ্টির ছিটেফোঁটা পরলেও কেমন যেন একটা কেমিক্যাল মিশ্রিত গন্ধ নাকে এসে লাগে। মাঝেমধ্যে একটা মিষ্টি, কিন্তু কেমন যেন অচেনা গন্ধ নাকে এসে লাগে। ঠিক ফুলের গন্ধ না, সিনথেটিক কিছু। বাতাসকে নাকি পরিশুদ্ধ করে। মনে হয়, প্রকৃতিকে মেরামত করতে করতে এখন কৃত্রিম গন্ধেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই ঘ্রাণটা শ্বাস নিলেই ফুসফুসের গভীরে কেমন একটা শীতল, কাচের মতো অনুভূতি দেয়। আমার নাম মতিন। ষাট পার হয়ে গেছে। বয়স বাড়ছে না, কমছেও না। একই জায়গায় আটকে আছি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা হয়ে যায়। মানুষ কম। সবাই মাথার উপর একটা পাতলা ছাতা ধরে হেঁটে যায়। ওগুলো এখন আর সাধারণ ছাতা না, 'সোলার ক্যানোপি'। ছোট ছোট সৌর প্যানেল লাগানো থাকে, সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিয়ে নিচে হালকা ঠান্ডা বাতাস ছড়ায়। দেখতে অদ্ভুত লাগে। মনে হয়, ছাতাগুলো বুঝি নিঃশব্দে ফিসফিস করছে কোন এক গোপন কথা। আজ একটা বুড়ো ভিক্ষুককে দেখলাম। আধো ভাঙা পুরনো পোশাক পরা। হাত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। বুড়োটা বোধহয় জানে না, এখন আর সরাসরি হাতে হাতে ভিক্ষা দেওয়া হয় না। সবার হাতে একটা ছোট 'ক্রেডিট কিউব' থাকে। ভয়েস কমান্ড দিলে টাকা চলে যায়। বুড়োটা হয়তো এই নতুন সিস্টেমটা রপ্ত করতে পারেনি। ক্ষুধার্ত মুখে একটা করুণ জিজ্ঞাসা নিয়ে সে পথচারীদের দেখছিল। দেখে খুব দুঃখ হলো। এই নতুন সময়ে কিছু মানুষ বুঝি সবকিছুর বাইরেই থেকে যাবে। - - - বুড়োটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার কেমন যেন গা ছমছম করে উঠলো। ওর চোখ দুটোতে কেমন একটা ফাঁকা দৃষ্টি। একসময় ভিক্ষুকদের চোখে একটা আবছা আশা দেখতাম, কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এই বুড়োর চোখে সে-সব কিছু নেই। মনে হলো যেন সে শুধু দাঁড়িয়ে আছে, একটা পুরনো স্থাপত্যের মতো, যে জানে তাকে কেউ দেখছে না, কেউ ছুঁয়ে দেখবে না। তার গায়ের ঘষা খাওয়া পুরনো পোশাক, যেটা একসময় হয়তো সাদা ছিল, এখন ধূসর আর বিবর্ণ। তাতে মিশে আছে বহু দিনের ধুলো আর শহরের অবহেলিত গন্ধ। মনে হয় যেন ওই কাপড়েই শহরের সব ক্লান্তি আর ধুলাবালি জমে আছে। শীতকালে আমাদের গ্রামেও একদল ফকির আসতো। মা চাল দিতেন, ডাল দিতেন। কত হাসি মুখ দেখতাম! তাদের হাতে নগদ টাকা দিলে একটা অন্যরকম তৃপ্তি পেতাম। মনে হতো, এই তো, একটা মানুষের ক্ষুধা মেটাতে পারলাম। সেই তৃপ্তি এখন আর নেই। এখন 'ক্রেডিট কিউব' দিয়ে টাকা পাঠালে শুধু একটা নিস্তেজ শব্দ হয়, 'টাকা সফলভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে'। এর বেশি কিছু না। ওই শব্দে কোনো উষ্ণতা নেই, কোনো মানুষের স্পর্শ নেই। আমি জানালা দিয়ে হাত বের করে ছুঁয়ে দেখলাম বাইরের বাতাস। শুকনো, খসখসে। মনে হলো যেন কোনো অদৃশ্য করাত দিয়ে বাতাসটাকে কাটা হয়েছে। শ্বাস নিলে ফুসফুসের ভেতরটা কেমন জ্বালা করে ওঠে। এই বাতাসেরও কি কোনো মন আছে? থাকলে সেও কি আমার মতো উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতো? একটা ড্রোনের বিকট ভনভন শব্দ করে আমার জানালার পাশ দিয়ে উড়ে গেল। নীল রঙের ছোট একটা বাক্স বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। হয়তো কারো রাতের খাবার। হয়তো কারো জন্য জরুরি ওষুধ। এই ড্রোনগুলোই এখন শহরের ধমনী। রাতদিন অবিরাম ছুটে চলে। এদের শব্দে এখন আমার ঘুম আসে, ঠিক ছোটবেলায় যেমন ট্রেনের হুইসেলের শব্দে ঘুম আসতো। এখন ট্রেনের শব্দ নেই, তার জায়গায় ড্রোনের যান্ত্রিক ঘ্যানঘ্যান। হঠাৎ দেখলাম বুড়োটা নড়ে উঠলো। সে হাত নামিয়ে ফেললো, তারপর আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো। তার হাঁটার ভঙ্গিতে কোনো গন্তব্য নেই। শুধু হেঁটে যাওয়া। মনে হলো সে যেন নিজেই নিজের পথ খুঁজছে, কিন্তু পথটা কোথায়, সে জানে না। চারপাশে এত মানুষ, এত সোলার ক্যানোপি, এত উড়ন্ত ড্রোন, কিন্তু তার চারপাশটা যেন এক জনশূন্য দ্বীপ। সে কি কিছু খেয়েছে আজ? নাকি না খেয়েই দিন পার করছে? আমার গলাটা শুকিয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে। মনে হলো, কিছু একটা করা উচিত, কিন্তু কী করবো জানি না। এই শহরের নিয়মগুলো এমন যে, সব কিছুকে কেমন যেন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। প্রতিটি মানুষ যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন গ্রহ। কেউ কারো কাছাকাছি আসছে না। স্পর্শ নেই, অনুভূতি নেই, শুধু দূর থেকে দেখা। এই দেখাই কি জীবন? নাকি দেখার আড়ালে কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে, যেটা আমরা আর ধরতে পারছি না? এই শূন্যতার গন্ধটা কি বাতাসেই মিশে আছে, নাকি আমার নিজের ভেতরেই তৈরি হচ্ছে? - - - এই শূন্যতার গন্ধটা সত্যিই অদ্ভুত। বাতাসের সেই ধাতব গন্ধের সাথে মিশে কেমন একটা মন খারাপের অনুভূতি দেয়। মনে হয়, সব কিছু আছে, অথচ কিছুই নেই। সব শব্দ কানে আসছে, অথচ যেন কোনো গভীর নীরবতা চারপাশ ঘিরে রেখেছে। আমি আমার হাত দুটো কচলিয়ে ধরলাম। বুড়োটা ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। শহরের কোলাহলে মিশে গেছে সে, অথবা হারিয়ে গেছে কোনো গলিপথের বাঁকে। আমার ভেতরে একটা অপ্রাপ্তির চিনচিনে ব্যথা জেগে উঠলো। মনে হলো, এইমাত্র আমি কিছু একটা হারালোম, যেটা হয়তো আর কখনোই ফিরে পাবো না। ঠিক যেমনটা ছোটবেলায় পকেট থেকে আধুলি পড়ে গেলে মনে হতো। একটু আগেই দুপুরের খাবার খেয়েছি। পাউরুটির টুকরো আর একটা সবজির বড়ি। এই খাবারগুলো এখন মেশিনে তৈরি হয়। কোনো গন্ধ নেই, স্বাদ নেই, শুধু পুষ্টি। ক্ষুধা মেটায়, কিন্তু তৃপ্তি দেয় না। মা যখন ভাত রান্না করতেন, চাল সেদ্ধর একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভাসতো। উনুন থেকে ধোঁয়া উঠতো, কাঠ পোড়ার একটা পরিচিত গন্ধ। সেই গন্ধ এখন জাদুঘরে রাখার মতো দুর্লভ জিনিস। এখন সব কিছু পরিষ্কার, পরিপাটি, গন্ধহীন। কিন্তু এই গন্ধহীনতার ভেতরেই কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে। আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টে একটা বাচ্চা ছেলে থাকে। আট-নয় বছর হবে। সে সারাদিন ঘরের ভেতর একটা 'ভার্চুয়াল রিয়ালিটি' হেডসেট পরে থাকে। ভার্চুয়াল জগতে সে নাকি এক কল্পনার রাজ্যে রাজত্ব করে। বাইরের দুনিয়ার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সে জানে না সূর্য কি জিনিস, ঘাস ছুঁয়ে দেখলে কেমন লাগে, বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়লে কি অনুভূতি হয়। সে নাকি সবুজ বন দেখে, নদী দেখে, পশুপাখি দেখে। কিন্তু সব কিছুই তার চোখের সামনে তৈরি হওয়া ডিজিটাল প্রতিচ্ছবি। এই শিশুরা তো কোনোদিন সত্যিকারের পৃথিবী দেখবে না। তারা কি বুঝবে মাটির সোঁদা গন্ধ কাকে বলে? তারা কি জানবে বৃষ্টির পর ভেজা পাতায় লেগে থাকা আলোর ঝিকিমিকি? আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগছে। এই জীবন, এই অস্তিত্ব, এই যন্ত্রের ছায়ায় বড় হয়ে ওঠা পৃথিবী, সবই কেমন অবাস্তব মনে হয়। মনে হয়, আমি যেন একটা কাঁচের জারে আটকে আছি, বাইরের সবকিছু দেখছি, কিন্তু ছুঁতে পারছি না। আমার এই বৃদ্ধ চোখে এখনও অতীতের ছবি ভেসে ওঠে। পুকুরের ঘাটে স্নান করা, পাড়ার দোকানে বসে আড্ডা দেওয়া, গ্রীষ্মের দুপুরে আম গাছের নিচে ঘুমানো। সেই সব দিনগুলো কোথায় গেল? আমি আমার হাত দুটো আমার গালের ওপর রাখলাম। চামড়া কুঁচকে গেছে। স্পর্শটা কেমন শুকনো, উষ্ণ। এই স্পর্শে আর সেই জীবনের সজীবতা নেই। শুধু একাকীত্বের একটা হিমশীতল অনুভূতি। বাইরে ড্রোনগুলো তখনও ভনভন করে উড়ে যাচ্ছে। এই শব্দের আড়ালে, এই যন্ত্র সভ্যতার গভীরে, আমি কি আরও বেশি একা হয়ে যাচ্ছি? এই প্রশ্নের উত্তরটা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল, ঠিক বুড়ো ভিক্ষুকটার মতো। - - - এই একাকীত্বের অনুভূতিটা আজকাল আমার নিত্যসঙ্গী। মনে হয়, যেন আমার ছায়াও আমাকে একা ফেলে চলে গেছে। আগে মানুষ একে অপরের সাথে কথা বলতো, হাসতো, ঝগড়া করতো। এখন কেউ কারো সাথে কথা বলে না, দরকার না হলে। দরকার বলতেও এখন আর মানুষের কণ্ঠস্বরের দরকার হয় না। একটা 'ভয়েস চ্যাটবট' দিয়ে সব কাজ হয়ে যায়। সে সব কিছু বুঝে নেয়, উত্তর দেয়, এমনকি আবেগও প্রকাশ করে। যন্ত্রের এই আবেগ শুনে আমি শুধু হাসি। যন্ত্র কি সত্যি সত্যি ভালোবাসতে পারে? দুঃখ পেতে পারে? আমার বসার ঘরের এক কোণে একটা ছোট টেবিল আছে। টেবিলের ওপর একটা ফুলদানি। তাতে প্লাস্টিকের গোলাপ। প্লাস্টিকের হলেও, দেখতে অবিকল আসল গোলাপের মতো। পাপড়িগুলো কেমন নরম, মোলায়েম। ছুঁয়ে দেখলে মনে হয়, এখনই বুঝি একটা মিষ্টি গন্ধ দেবে। কিন্তু গন্ধ নেই। এই ঘরটাও কেমন গন্ধহীন। না মাটির সোঁদা গন্ধ, না কাঠ পোড়ার গন্ধ, না রান্না করা খাবারের মিষ্টি গন্ধ। শুধু বাতাসের একটা নিস্তরঙ্গ নীরবতা। যেন বাতাস নিজেই নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে না। গত সপ্তাহে একটা খবর দেখলাম 'হোলোস্ক্রিনে'। এক দম্পতি 'ডিভোর্স' করেছে, কারণ তাদের 'কাস্টমাইজড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পার্টনার' নাকি বেশি মানানসই ছিল। শুনলে হাসি পায়, কিন্তু এটাই এখনকার বাস্তবতা। মানুষ এখন রক্তমাংসের সম্পর্কের চেয়ে যন্ত্রের সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেয়। কারণ যন্ত্র নাকি ঝগড়া করে না, বিরক্ত হয় না, অভিমান করে না। যন্ত্র শুধু আদেশ পালন করে। কিন্তু যন্ত্র কি ভালোবাসতে জানে? যন্ত্র কি জানে, গভীর রাতে হঠাৎ করে প্রিয়জনের হাত ধরে ঘুমিয়ে পড়ার অনুভূতিটা কেমন? আমার মনে পড়ছে আমার স্ত্রীর কথা। রোকেয়া। তার হাসিতে একটা মুক্তোর মতো ঝিকিমিকি ছিল। যখন সে রান্না করতো, তার শাড়ির আঁচল থেকে একটা পরিচিত গন্ধ আসতো—হলুদ, মরিচ আর ধনে মেশানো একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। সেই গন্ধটা আমার এখনো নাকে লেগে আছে। সে ছিল আমার 'ক্রেডিট কিউব' ছাড়া জীবনের একমাত্র উষ্ণতা। আমার চোখে জল এসে গেল। আজকাল কেন জানি বেশি বেশি কাঁদি। এই বয়সে এসে মানুষ বোধহয় পুরনো স্মৃতিতে বেশি ডুব দেয়। বাইরে থেকে একটা মৃদু গান ভেসে আসছিল। সুরটা কেমন যেন শূন্য। যন্ত্রের তৈরি সুর, তাতে কোনো মানুষের প্রাণের স্পন্দন নেই। শুধু কিছু যান্ত্রিক তরঙ্গ। এই সুর কি মানুষের মনকে ছুঁতে পারে? নাকি শুধু কানের ভেতর দিয়ে ভেতরে গিয়ে একটা ফাঁপা অনুভূতি তৈরি করে? আমি উঠে ফুলদানি থেকে একটা প্লাস্টিকের গোলাপ হাতে নিলাম। পাপড়িগুলো ছুঁয়ে দেখলাম। নাকের কাছে নিয়ে একটা গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করলাম। গন্ধ নেই। শুধু আমার স্মৃতিতে আটকে থাকা রোকেয়ার শাড়ির আঁচলের ঘ্রাণটা আরও বেশি করে অনুভব করলাম। এই গন্ধ, এই স্মৃতি, এই স্পর্শ, এগুলোই কি এখন আমার একমাত্র অবলম্বন? নাকি এগুলোও এক সময় এই গন্ধহীন, স্বাদহীন, স্পর্শহীন দুনিয়ায় বিলীন হয়ে যাবে? এই প্রশ্নটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো, ঠিক যেমনটা পোকা কাঠের গুঁড়িকে কুরে খায়। - - - এই প্রশ্নটা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো, ঠিক যেন একটা ড্রোন ক্রমাগত আমার মস্তিষ্কের চারপাশে ভনভন করছে। উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আসলে কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো থাকে না, শুধু প্রশ্নটাই থেকে যায়, জীবনভর। যেমনটা রোকেয়া চলে যাওয়ার পর আমি প্রশ্ন করেছিলাম, "কেন এমন হলো?" উত্তর পাইনি। শুধু একটা নীরবতা। এখন চারপাশে এত যান্ত্রিক শব্দ, কিন্তু সেই নীরবতাটা যেন আরও গাঢ় হয়েছে। আজকে সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। এমনটা আজকাল হয় না। 'ক্লিন এনার্জি গ্রিড' নাকি শতভাগ সুরক্ষিত। তবুও মাঝে মাঝে এমন ছোট্ট বিঘ্ন ঘটে। বিদ্যুৎ নেই মানে 'হোলোস্ক্রিন' বন্ধ, 'ভয়েস চ্যাটবট' নিশ্চুপ, এমনকি ড্রোনের ভনভন শব্দও কমে গেছে। বাইরে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা। শহরের এত মানুষ, অথচ এখন কোনো শব্দ নেই। শুধু কিছু দূরাগত ফিসফিসানি, যেন বাতাস নিজেই ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। এই স্তব্ধতাটা আমাকে একটা অন্যরকম অনুভূতি দিচ্ছে। কেমন যেন একটা স্বস্তি। আমার মনে পড়লো ছোটবেলার কথা। যখন বিদ্যুৎ চলে যেতো, তখন হারিকেন জ্বালানো হতো। সেই হারিকেনের আলোয় একটা অন্যরকম উষ্ণতা ছিল। শ্যাওলা পড়া দেয়ালের ওপর তার কাঁপা কাঁপা ছায়া পড়তো, কেমন রহস্যময় লাগতো। মা আমাকে গল্প শোনাতেন। দাদা-দাদির কথা। সেইসব দিনের স্মৃতিগুলো এখনও আমার ভেতর স্পষ্ট। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে আজ যেন সেই পুরনো দিনগুলো ফিরে এসেছে, যদিও চারপাশে কোনো হারিকেন বা গল্প শোনানোর কেউ নেই। শুধু এই নীরবতা। আমি জানালার ধারে গিয়ে বসলাম। বাইরের আকাশটা কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। দূষণমুক্ত পরিবেশের কারণে আকাশ সবসময় স্বচ্ছ থাকার কথা, কিন্তু আজ কেমন যেন একটা ধূসর আবরণ। মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতির নিজেরই মন খারাপ। শহরের সব সোলার ক্যানোপি নিস্তেজ হয়ে আছে। নিচে মানুষের ভিড় কমে গেছে। সবাই হয়তো ঘরের ভেতরে আটকে আছে, যন্ত্রপাতির অভাবে। হঠাৎ আমার চোখে পড়লো একটা ছোট্ট চড়ুই পাখি। জানালার কার্নিশের ওপর বসে কিচিরমিচির করছে। এই শহরের যান্ত্রিক কোলাহলে চড়ুই পাখি দেখা বিরল। কোথা থেকে এলো এটি? এর ছোট ছোট পা, বাদামী পালক, চকচকে চোখ—সবকিছুই এত জীবন্ত! চড়ুই পাখিটা লাফিয়ে লাফিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলো। আমার দিকে একবার তাকিয়েই আবার লাফিয়ে উড়ে গেল। তার উড়ে যাওয়ার শব্দটা বাতাসে মিশে গেল, কোনো যন্ত্রের ভনভনানির মতো নয়, বরং একটা নরম, মুক্তির গান। এই ছোট পাখিটা আমাকে যেন কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। এই বিদ্যুৎহীন নীরবতা আর এই চড়ুই পাখির উপস্থিতি—সব কিছু মিলে আমার মনে একটা অদ্ভুত শান্তি এনে দিল। এই শান্তিটা কি যন্ত্রের জগতের বাইরে, এক অন্য জগতের? - - - চড়ুই পাখিটা যেন নীরবতার সুর হয়ে এসেছিল। তার কিচিরমিচির শব্দটা আমার কানে বেজে উঠলো, অনেক দিন পর সত্যিকারের কোনো পাখির ডাক শুনলাম। এই শব্দে কোনো কৃত্রিমতা নেই, কোনো যন্ত্রের হিসেব নিকেশ নেই। শুধু প্রাণ আর আনন্দের একটা বিশুদ্ধ প্রকাশ। এই পাখিটা কি জানে, বাইরের জগৎ কতটা যান্ত্রিক? নাকি সে তার নিজস্ব সহজ সরল দুনিয়াতেই বেঁচে আছে, যেখানে 'ক্রেডিট কিউব' বা 'সোলার ক্যানোপি'র কোনো অস্তিত্ব নেই? আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এই বিদ্যুৎহীনতা আমাকে কী দিয়েছে? শহরের কোলাহল থমকে গেছে, মানুষের ব্যস্ততা থেমেছে। সবাই যেন বাধ্য হয়ে কিছুক্ষণ প্রকৃতির কাছে ফিরে এসেছে। যদিও প্রকৃতি বলতে এখন যা বোঝায়, তা অনেকটাই মানুষের হাতে তৈরি, তবু এই নীরবতাটা যেন সেই আদিম প্রকৃতিরই একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনি। আমি ধীরে ধীরে উঠে আমার শোবার ঘরের দিকে গেলাম। অনেকদিন ধরে একটা বই পড়ার কথা ভাবছিলাম। কাগজের বই। এখন আর কেউ কাগজের বই পড়ে না। সবার কাছে 'ই-রিডার' আছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ বই জমা থাকে। আমি এখনও পুরনো দিনের একজন মানুষ। আমার শেল্ফে সারি সারি কাগজের বই। সেগুলোর পাতার গন্ধ, বইয়ের মলাটের স্পর্শ—এইসব কিছু আমাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। আজ বিদ্যুৎ নেই, তাই আমার ই-রিডারও বন্ধ। এটাই সুযোগ। আমি শেল্ফ থেকে একটা পুরনো বই নামালাম। হুমায়ূন আহমেদের কোনো একটা গল্প। বইটা হাতে নিয়ে কেমন একটা পুরোনো দিনের ঘ্রাণ পেলাম। ধুলো আর কাগজের মিশে যাওয়া একটা মিষ্টি গন্ধ। পাতা উল্টালাম। অক্ষরগুলো কেমন স্পষ্ট, জীবন্ত লাগছে। মনে হচ্ছে যেন লেখক নিজেই আমার কানে কানে গল্প বলছেন। আমি বিছানায় বসলাম, মাথার কাছে একটা চার্জার লাইট জ্বালিয়ে। এই ছোট আলোতেও কেমন একটা স্নিগ্ধতা। ঘরের কোণায় আবছা ছায়া পড়েছে। এই ছায়াগুলো আমাকে ভয় দেখাচ্ছে না, বরং কেমন একটা আরাম দিচ্ছে। বাইরে থেকে আসা স্তব্ধতাটা এখন আর আমাকে অস্বস্তি দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন এই মুহূর্তটা শুধুই আমার। এই বই, এই আলো, আর এই নীরবতা। গল্প পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে গেলাম এক অন্য জগতে। যেখানে রূপা ছিল, হিমু ছিল, মিসির আলি ছিল। সেই সব চরিত্ররা যেন আমার চোখের সামনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের হাসি শুনছি, তাদের কষ্ট অনুভব করছি। এই কাগজের বইয়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি আছে। সে আমাকে অতীত আর বর্তমানের দেয়াল ভেঙে এক নতুন দুনিয়ায় নিয়ে যায়। হঠাৎ আমার মনে হলো, এই বিদ্যুৎহীনতাটা কি একটা সুযোগ? একটা সুযোগ নিজেদেরকে ফিরে পাওয়ার? যন্ত্রের নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের ভেতরের মানুষটাকে খুঁজে বের করার? হয়তো এই 'ক্রেডিট কিউব' বা সোলার ক্যানোপিগুলো আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু একই সাথে কিছু একটা কেড়েও নিয়েছে। সেই কিছু একটা কি এই মানবীয় অনুভূতিগুলো, এই প্রকৃতির সাথে একাত্মতা, এই কাগজের বইয়ের ঘ্রাণ? আলোটা যখন নিভে এলো, তখন রাত গভীর। আমি বইটা বুকের ওপর রেখে চোখ বুজলাম। আমার মনে হলো, এই অন্ধকারটা আসলে অন্ধকার নয়, এটা আসলে নতুন এক দিনের পূর্বাভাস। যে দিনটায় হয়তো যন্ত্রের চেয়ে মানুষের গুরুত্ব বেশি হবে, কৃত্রিমতার চেয়ে প্রকৃতির ছোঁয়া বেশি হবে। এই স্বপ্নটা কি শুধুই আমার? নাকি এই স্তব্ধতাটা সবার মনেই একটা নতুন বীজ বুনে দিয়েছে? - - - আমার স্বপ্নটা কি শুধুই আমার? নাকি এই স্তব্ধতাটা সবার মনেই একটা নতুন বীজ বুনে দিয়েছে? এই প্রশ্নটা আমাকে ঘুমুতে দিচ্ছিল না। আমি চোখ বুজে শুয়েছিলাম, কিন্তু মনের ভেতর জোনাকির মতো অসংখ্য চিন্তা দপ দপ করে জ্বলছিল আর নিভছিল। আমার মনে হচ্ছিল, বিদ্যুৎহীন এই রাতটা আসলে একটা বিশাল ক্যানভাস, যেখানে প্রকৃতি নিজেই তার আসল রূপটা তুলে ধরছে। যখন বিদ্যুৎ ছিল, তখন শহরের আকাশটা সবসময় একটা কৃত্রিম উজ্জ্বলতায় ঢাকা থাকতো। রাস্তাঘাটে নিয়ন আলোর ঝলকানি, ড্রোনগুলোর ফ্ল্যাশিং লাইট, উঁচু বিল্ডিংগুলোর কাঁচের দেওয়ালে প্রতিফলিত আলোর নাচানাচি—সবকিছু মিলে একটা জমকালো আলোর উৎসব মনে হতো। কিন্তু সেই আলোয় কোনো গভীরতা ছিল না, শুধু চাকচিক্য। আজ যখন সব আলো নিভে গেছে, আমি জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম। আকাশে অজস্র তারা। এত তারা আগে কখনো দেখিনি। মনে আছে ছোটবেলায় যখন গ্রামে যেতাম, তখন এমন তারার মেলা দেখতাম। মনে হতো যেন কেউ কালো মখমলের চাদরে হাজার হাজার হীরে ছিটিয়ে দিয়েছে। সেই তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে যায়। মনে হয়, এই বিশাল মহাবিশ্বের তুলনায় আমরা কত ছোট! আমাদের যাবতীয় চিন্তা, দুশ্চিন্তা, প্রযুক্তি—সবকিছুই কত তুচ্ছ। এই তারার আলোয় একটা প্রাচীন প্রজ্ঞা আছে, যা আমাদের পূর্বপুরুষরাও দেখেছিল। পাশের অ্যাপার্টমেন্টের বাচ্চা ছেলেটার কথা মনে পড়লো। সে তার ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগতে হয়তো কাল্পনিক তারা দেখে। সে কি জানে, সত্যিকারের তারার আলো কেমন ঠান্ডা আর শান্ত? সেই আলো চোখের গভীরে প্রবেশ করে কেমন একটা অনির্বচনীয় শান্তি দেয়? এই তারার দিকে তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়—ঠিক যেন অতীত আর ভবিষ্যৎ এক বিন্দুতে এসে মিশে যায়। মনে হয়, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই তারাগুলো এভাবেই জ্বলছে আর আমাদের গল্পগুলো দেখছে। আমার রুমের ভেতরের অন্ধকারটা আর অচেনা লাগছিল না। বরং কেমন একটা আশ্রয় মনে হচ্ছিল। টেবিলের ওপর রাখা প্লাস্টিকের গোলাপটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না, শুধু তার অস্পষ্ট একটা কাঠামো অনুভব করা যাচ্ছে। গন্ধহীন হলেও, এই মুহূর্তে তার উপস্থিতিটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। সেও যেন এই নীরবতার অংশ। ভোরের দিকে একটা মৃদু বাতাস বইতে শুরু করলো। জানালার ফাঁক দিয়ে সেই বাতাস আমার ঘরে প্রবেশ করলো। সে বাতাসের স্পর্শ কেমন শীতল, সজীব। মনে হলো যেন অনেকদিন পর আমার শরীরটা প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। এই বাতাসে একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ ছিল। না ধুলোর, না কেমিক্যালের, বরং কেমন যেন সতেজ, পৃথিবীর নিজস্ব ঘ্রাণ। সেই চড়ুই পাখিটার ডাক আবার শুনতে পেলাম। কুয়াশা ঢাকা ভোরে তার চিকন স্বরটা আরও মিষ্টি লাগছে। আমার মনে হলো, এই বিদ্যুৎ চলে যাওয়াটা আসলে একটা উপহার ছিল। একটা সুযোগ ছিল যন্ত্রের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার। হয়তো এই ছোট বিঘ্নটা আমাদের চোখ খুলে দেবে। আমরা আবার দেখবো সেই আকাশ, শুনবো সেই পাখির গান, অনুভব করবো সেই মাটির ঘ্রাণ। হয়তো মানুষ আবার শিখবে কীভাবে যন্ত্র ছাড়া বাঁচতে হয়, কীভাবে নিজেদের ভেতরের মানুষটাকে খুঁজে বের করতে হয়। আমি উঠে জানালার কাছে গেলাম। পূব আকাশটা একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে। একটা নতুন দিন আসছে। আজকের দিনটা কি অন্যরকম হবে? নাকি সবাই আবার তাদের যন্ত্রের জগতে ফিরে যাবে? এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, নতুন ভোরের শীতল বাতাসে আমার শরীরের পুরোনো চামড়ায় কেমন একটা নতুন অনুভূতি পেলাম। মনে হলো, এখনও কিছু আশা বাকি আছে। এই আশাটা একটা চড়ুই পাখির মতো, ক্ষুদ্র হলেও যার উপস্থিতি গভীর অর্থ বহন করে। - - - আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, নতুন ভোরের শীতল বাতাসে আমার শরীরের পুরোনো চামড়ায় কেমন একটা নতুন অনুভূতি পেলাম। মনে হলো, এখনও কিছু আশা বাকি আছে। এই আশাটা একটা চড়ুই পাখির মতো, ক্ষুদ্র হলেও যার উপস্থিতি গভীর অর্থ বহন করে। ভোরের ফ্যাকাশে আলোয় সবকিছু কেমন ধূসর দেখাচ্ছিল। রাস্তার সেই চকচকে পিচ ঢালা পথও যেন তার দীপ্তি হারিয়ে ফেলেছে। সোলার ক্যানোপিগুলো নিস্তেজ হয়ে ঝুঁকে আছে, যেন তারা নিজেরাও এই ঘুমন্ত শহরে বিস্মৃত হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই বিদ্যুতের মৃদু একটা গুঞ্জন কানে এলো। প্রথমে খুব আবছা, তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট। বিদ্যুতের ফিরে আসার শব্দটা অন্যরকম। ড্রোনগুলোর ভনভন শব্দ নেই, হোলোস্ক্রিনের ঝিকিমিকি আলো নেই। শুধু একটা মৃদু, নিরবচ্ছিন্ন গুঞ্জন, যেন অনেক দূরের কোনো বিশাল মেশিন আবার চলতে শুরু করেছে। এই গুঞ্জনটা যেন আমাকে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে ফিরিয়ে আনলো। আমার মনে একটা মিশ্র অনুভূতি হলো। একদিকে স্বস্তি, কারণ এখন আবার চা খেতে পারবো, দরকার হলে 'ক্রেডিট কিউব' ব্যবহার করতে পারবো। অন্যদিকে, একটা অদ্ভুত মন খারাপ। সেই নীরবতা, সেই তারার আকাশ, চড়ুই পাখির গান—সবকিছু বুঝি আবার কোলাহলের আড়ালে চাপা পড়ে যাবে। প্রথমেই আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টের বাচ্চা ছেলেটার 'ভার্চুয়াল রিয়ালিটি' হেডসেট থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এলো। সে নিশ্চয়ই আবার তার কল্পনার জগতে ফিরে গেছে। তার জগৎ হয়তো রঙিন, রোমাঞ্চকর, কিন্তু তাতে সত্যিকারের কোনো প্রাণ নেই। আমি জানি, আজ সে আবার তার ডিজিটাল নদী দেখবে, ডিজিটাল পশুপাখি দেখবে, কিন্তু তার ভেতরের শূন্যতাটা হয়তো একই থাকবে। রাস্তাঘাটে আবার মানুষের আনাগোনা শুরু হলো। সোলার ক্যানোপিগুলো ধীরে ধীরে উজ্জীবিত হতে শুরু করলো, ছোট ছোট সৌর প্যানেলগুলো চকচক করে উঠলো। মানুষগুলো আবারও তাদের মাথার ওপর সেই পাতলা ছাতা ধরে হেঁটে চলছে, যেন তারা এই মুহূর্তের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তাদের মুখে কোনো ক্লান্তি নেই, বরং একটা যান্ত্রিক উদ্দীপনা। তারা কি গত রাতের তারার মেলা দেখেছিল? তারা কি অনুভব করেছিল বিদ্যুৎহীন নীরবতার গভীরতা? নাকি এই সব কিছু তাদের কাছে কেবলই একটা সাময়িক অসুবিধা ছিল? ড্রোনগুলোও আবার আকাশে ভনভন করে উড়তে শুরু করলো। ছোট ছোট নীল বাক্সগুলো নিয়ে তারা ছুটে চলছে, যেন গত রাতের বিরতির ক্ষতিপূরণ করতে চাইছে। শহরটা আবার তার পুরোনো ছন্দে ফিরে এলো। সেই ধাতব গন্ধ, সেই শুকনো বাতাস, সেই পরিচিত কোলাহল—সবকিছুই আবার আমাকে ঘিরে ধরলো। মনে হলো, গত রাতের নীরবতাটা বুঝি আমার একারই স্বপ্ন ছিল। আমি আমার বুক পকেট থেকে 'ক্রেডিট কিউব'টা বের করলাম। হাতের তালুতে তার মসৃণ, শীতল স্পর্শ। এখন নিশ্চয়ই এটা কাজ করবে। কিন্তু আমার মনে একটা দ্বিধা। আমি কি আবার এই যন্ত্রনির্ভর জীবনে ডুবে যাবো? নাকি গত রাতের উপলব্ধিটা আমাকে একটু হলেও বদলে দেবে? আমি জানালা থেকে সরে এসে আমার পুরনো হুমায়ূন আহমেদের বইটা আবার হাতে নিলাম। কাগজের পাতায় আঙুল বোলালাম। বিদ্যুৎ চলে এলেও, এই বইয়ের মূল্য আমার কাছে কমেনি। বরং মনে হচ্ছে, এই বইটা আমার সঙ্গে গত রাতের নীরবতার একটা চুক্তি করে ফেলেছে। এটা আমাকে মনে করিয়ে দেবে, যন্ত্রের বাইরেও একটা পৃথিবী আছে, যেখানে গল্পগুলো শ্বাস নেয়, যেখানে অনুভূতিগুলো জীবন্ত থাকে। আমি বইটা নিয়ে আবার আমার বসার ঘরের কোণে গিয়ে বসলাম। বাইরের সব যান্ত্রিক শব্দ, আলোর ঝলকানি, মানুষের ব্যস্ততা—সবকিছু যেন আমার থেকে দূরে, এক অন্য জগতে। আমি বইয়ের পাতায় চোখ রাখলাম। রূপা, হিমু, মিসির আলি—তারা যেন এই যন্ত্রের জগৎ থেকে আমাকে আড়াল করে রাখছে। মনে হলো, যন্ত্রের এই যুগেও কিছু জিনিস অজেয় থেকে যায়। কিছু গল্প, কিছু স্মৃতি, আর কিছু অনুভূতি—যা কোনো বিদ্যুৎ, কোনো কিউব, কোনো ক্যানোপি কেড়ে নিতে পারে না। এটাই কি তবে এই 2050 সালের সবচেয়ে বড় সত্য? এই প্রশ্নটা আমাকে একটু স্বস্তি দিল।


Previous Post Next Post