আমার বিড়ালটার নাম নিউটন। সে আজ সকালে তার সাদা বাটি থেকে দুধ খেতে খেতে মুখ তুলে বলল, "তোমার এই চায়ের কাপটা সিরামিকের। জিনিসটা মূলত ক্যাওলিনাইট নামের একধরনের অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট ক্লে। আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করা।"
আমি বিরক্ত মুখে তাকালাম। "আবার শুরু করেছিস?"
নিউটন পাত্তা দিল না। সে তার গোলাপি জিভ দিয়ে গোঁফ পরিষ্কার করতে করতে বলল, "তুমি কি জানো মানুষের শরীরের প্রতিটা কোষ প্রতিদিন গড়ে পঞ্চাশ থেকে সত্তর বিলিয়ন বার মরে যায়? এটাকে বলে অ্যাপোপটোসিস। মানে প্রোগ্রাম করা কোষীয় আত্মহত্যা। তোমার আমার শরীর টিকে আছে এই সুশৃঙ্খল আত্মহত্যার ওপর ভর করে।"
আমি খবরের কাগজে চোখ রাখলাম। নিউটনের এই জ্ঞানবুলি নতুন কিছু নয়। মাস তিনেক হলো সে কথা বলতে শিখেছে। প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বেশ কাজে দেয়। সেদিন বাথরুমের বেসিন জ্যাম হয়ে গিয়েছিল, নিউটনই বলল ভিনেগার আর বেকিং সোডা একসাথে ঢাললে কার্বন ডাই অক্সাইডের চাপে ময়লা ছুটে যাবে। গিয়েছিল।
"শোনো," নিউটন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল। বিড়ালের গলা খাঁকারি খুব অদ্ভুত শোনায়। "আসল কথায় আসি।"
"বল।"
"সময় বেঁকে যাচ্ছে।"
আমি খবরের কাগজ থেকে চোখ সরালাম। "মানে?"
"মানে খুব সোজা। সময় সরলরেখায় চলে না, এটা তো তুমি জানো। এটা একটা নদীর মতো। আইনস্টাইন বলে গেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, নদীর কোনো একটা অংশে একটা বড় পাথর পড়েছে। তাই স্রোতটা অন্যদিকে বইতে শুরু করেছে। আমাদের এই রিয়্যালিটি সেই বাঁকানো স্রোতের মধ্যে পড়ে গেছে।"
আমার কপালে ভাঁজ পড়ল। "কিছু বুঝতে পারছি না। সোজা করে বল।"
"সোজা কথা হলো, গতকাল রাতে তুমি যে ঘুমিয়েছো, সেটা ছিল মঙ্গলবার। আজ সকালে উঠেছো, আজও মঙ্গলবার। এবং কাল সকালেও তুমি মঙ্গলবারেই উঠবে।"
আমি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম। দেয়াল ক্যালেন্ডারে লাল কালিতে আজকের তারিখ, বার, সব ঠিকঠাক লেখা। "বাজে কথা বলবি না। আজ বুধবার।"
"ওটা তোমার দেখার ভুল। ক্যালেন্ডার একটা ছাপানো কাগজ। সে বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। বাস্তবতা ক্যালেন্ডারকে নিয়ন্ত্রণ করে," নিউটন হাই তুলল। "আমরা একটা টাইম লুপে আটকে গেছি। একটা অনন্ত মঙ্গলবারে।"
আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। এই প্রথম নিউটনের কথায় আমার সত্যিকারের ভয় লাগল। টাইম লুপ মানে তো ভয়াবহ ব্যাপার। সিনেমার মতো। প্রতিদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
"কিন্তু... আমি তো সকালে নতুন খবর পড়ছি।"
"কাগজওয়ালারাও এই লুপের অংশ। তারাও নতুন কাগজ ছাপছে, কারণ তাদের কাছেও এটা নতুন সকাল। কিন্তু ইউনিভার্সাল ক্লক এগোচ্ছে না। আমরা সবাই একটা ভাঙা রেকর্ডের খাঁজে আটকে আছি।"
"এর কারণ কী?" আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম।
নিউটন জানালার দিকে তাকাল। তার সবুজ চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। "কারণটা জটিল। মঙ্গোলিয়ার কোনো এক পাহাড়ে একটা লোক ধ্যানে বসেছিল। সে লোকটা সাধারণ কেউ নয়। তার ধ্যান ভাঙার কথা ছিল আজ সূর্যাস্তের সময়। কিন্তু গতকাল বিকেলে একটা ভাইপার সাপ তাকে কামড়ায়। লোকটা মারা গেছে।"
"তাতে কী?"
"তাতে এই হয়েছে যে, লোকটার ধ্যানটা আর ভাঙবে না। সে অনন্ত ধ্যানে চলে গেছে। তার চেতনাবস্থা সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহকে আটকে দিয়েছে। ওই লোকটাই ছিল সেই 'পাথর', যেটা নদীর স্রোতে পড়েছে।"
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। একটা লোক মঙ্গোলিয়ায় মারা গেছে বলে আমি আর বুধবার পাচ্ছি না, এটা কেমন কথা!
"এখন উপায়?"
নিউটন আমার দিকে ফিরল। তার দৃষ্টি গভীর, প্রাচীন। "উপায় একটা আছে। খুব সূক্ষ্ম একটা কাজ করতে হবে।"
"কী কাজ?"
"আজ রাত ঠিক দুটো বেজে চুয়ান্ন মিনিটে, যখন কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের ঘনত্ব সবচেয়ে কম থাকে, তখন তোমাকে তোমার রান্নাঘরের সিঙ্কে গিয়ে ঠিক তিন ফোঁটা লেবুর রস ফেলতে হবে।"
আমি হতভম্ব। "লেবুর রস?"
"হ্যাঁ। লেবুর রসে সাইট্রিক অ্যাসিড আছে। এই অ্যাসিড যখন ঠিক ওই নির্দিষ্ট সময়ে সিঙ্কের স্টিলের ওপর পড়বে, তখন একটা ক্ষুদ্র 'কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন' তৈরি হবে। সেই তরঙ্গটা মঙ্গোলিয়ার ওই মৃত লোকটার ধ্যানাবস্থার সাথে রেজোনেট করবে। তার চেতনা মুক্তি পাবে। সময় আবার চলতে শুরু করবে।"
আমি নিউটনের দিকে তাকিয়ে আছি। সে শান্তভাবে আবার দুধের বাটিতে মুখ ডোবাল।
আমার হাতে খবরের কাগজ। কপালে ঘাম জমছে। লেবুর রস। রাত দুটো চুয়ান্ন।
নিউটন মুখ তুলে বলল, "আর হ্যাঁ, ফ্রিজে লেবু না থাকলে এক্ষুনি কিনে এনো। লুপ ভাঙলে কাল কিন্তু আর এই লেবু কেনার সুযোগ পাবে না। তখন বুধবারের বাজারদর অন্যরকম থাকতে পারে।"
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। জুতোর ফিতা বাঁধতে বাঁধতে ভাবছি, নিউটন কি আমার সাথে কোনো সূক্ষ্ম রসিকতা করছে? নাকি সত্যিই আজ রাতে আমার তিন ফোঁটা লেবুর রসের ওপর পুরো পৃথিবীর বুধবার নির্ভর করছে?
বাজারের থলেটা হাতে নিলাম। যা থাকে কপালে। একটা চান্স তো নেয়াই যায়।
