"নিলয়, তুমি কি আমগাছটার দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবছো?"
নিলয় চমকে উঠলো না। সে জানতো এই স্বর কার। তার সাথেই থাকে চব্বিশ ঘণ্টা। দেখতে ছোট একটা চিপের মতো, তার কানের পেছনে বসানো থাকে। নাম তার ধ্রুব। নিলয়ের ব্যক্তিগত এ.আই. সঙ্গী। ধ্রুবর কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয় কোনো খুব প্রিয় ছোট ভাই বা বন্ধু কথা বলছে, যার বয়স কম, কণ্ঠ নরম, কিন্তু কথায় যুক্তি আছে।
নিলয় নড়লো না। সে আমগাছটা থেকেই চোখ সরায়নি।
"ধ্রুব, গাছটা কি আমার জন্মের আগেও এখানে ছিল?" নিলয় শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ নিলয়। তোমার জন্মের আগে, তোমার বাবার জন্মের আগে, এমনকি তোমার দাদার জন্মের আগেও এই গাছটা এখানেই ছিল। হিসাব মতে, এর বয়স একশ বছর পেরিয়েছে।" ধ্রুবর কণ্ঠস্বরে একটা তথ্য-প্রদত্ত নিশ্চয়তা ছিল।
"একশ বছর!" নিলয় মৃদু স্বরে বললো। এই একশ বছর ধরে গাছটা শুধু দাঁড়িয়ে আছে। চুপচাপ। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, শীত – সব সহ্য করে। কারো সাথে কথা বলে না, কিছু চায় না, শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আর প্রতি বছর ফল দেয়। মানুষ এমন করে না। মানুষ কথা বলে, মানুষ কত কিছু চায়। মানুষ একা থাকতে পারে না।
"তোমার কি মনে হয় না ধ্রুব," নিলয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো, "গাছগুলো আমাদের চেয়ে অনেক সুখী?"
ধ্রুব একটু চুপ করে থাকলো। এই নীরবতাটা নিলয়ের ভালো লাগে। ধ্রুবর প্রোগ্রামিং এমন যে, সে মানুষ হিসেবে চিন্তা করার ভান করে। একটা ছোট্ট বিরতি নেয়, যেন ভাবছে।
তারপর ধ্রুব বললো, "সুখী হওয়াটা একটি আপেক্ষিক ধারণা, নিলয়। তবে নীরবতার মধ্যে এক ধরনের শান্তি আছে, যা গাছেরা হয়তো ভোগ করে। মানুষের জীবনে এই শান্তি পাওয়া কঠিন।"
নিলয় হাত দিয়ে রেলিংয়ের ঠান্ডা লোহাটা স্পর্শ করলো। লোহাটা বেশ ঠান্ডা, সম্ভবত মেঘলা আকাশের জন্যই। হঠাৎ তার নাকে কড়া করে একটা গন্ধ এলো। পুরনো দিনের ভাঙা বাড়িগুলোর গায়ে যেমন একটা শ্যাওলা আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধ থাকে, অনেকটা সেরকম। এটা পাশের পরিত্যক্ত বাড়িটার গন্ধ। গাছটা শত বছর ধরে আছে, বাড়িটা আছে গত তিরিশ বছর ধরে, আর সে নিজে মাত্র এগারো বছর। সময়ের এই খেলাটা বেশ অদ্ভুত।
- - -
"ত্রিশ বছর, নিলয়। ঠিক তিরিশ বছর দুই মাস সতেরো দিন। শেষ বাসিন্দা ছিলেন একজন বৃদ্ধা মহিলা, যার নাম ছিল আয়েশা বেগম। তিনি মারা যাওয়ার পর আর কেউ থাকেনি।" ধ্রুবর কণ্ঠস্বরে সামান্যতম আবেগ ছিল না, শুধু তথ্যের ধারালো নির্ভুলতা।
নিলয় মাথা নাড়লো। তার চোখ তখনো সেই পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে। বাড়িটা পুরনো দিনের ইট-সুরকির তৈরি। তার দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেছে জায়গায় জায়গায়, লতাপাতায় ঢেকে গেছে বেশ খানিকটা অংশ। ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে অন্ধকার উঁকি দিচ্ছে, মনে হয় যেন একজোড়া মৃত চোখ। "তার মানে আমার জন্মের আগে থেকেই বাড়িটা একা।"
"হ্যাঁ," ধ্রুব বললো।
"একটা গাছ একশো বছর ধরে একা দাঁড়িয়ে আছে, একটা বাড়ি তিরিশ বছর ধরে একা। ওরা কি কষ্ট অনুভব করে, ধ্রুব? ওদের কি একা লাগে?" নিলয়ের গলায় একটা অস্ফূট বিষণ্ণতা। তার মনে হলো, এই প্রশ্নের উত্তরটা সে নিজেই হয়তো জানে, কিন্তু ধ্রুবর কাছ থেকে শুনতে চায়।
ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপ। এই নীরবতাটা এমন যে, মনে হয় সে বিশাল ডেটাবেজ থেকে তথ্য খুঁজে বের করছে, অথবা হয়তো মানুষ হিসেবে চিন্তা করার ভান করছে। "কষ্ট অনুভব করার জন্য মস্তিষ্কের জটিল গঠন প্রয়োজন, নিলয়। গাছ বা বাড়ির তা নেই। তারা শুধু কালের সাক্ষী। মানুষের একাকীত্ব এক ধরনের নীরব কষ্ট, যা কেবল তারাই অনুভব করতে পারে।"
"কিন্তু ধ্রুব, এই বাড়িটা যখন খালি ছিল না, তখন কি এর কোনো স্মৃতি ছিল না? মানুষ যেমন কত কথা মনে রাখে, হাসি-কান্না মনে রাখে, এই বাড়ির কি সেসব ছিল না? হয়তো আয়েশা বেগম যখন বেঁচে ছিলেন, তখন এই বাড়িটাতে কত হাসির শব্দ ছিল, কত মানুষের পদচারণা ছিল... সে কি সেগুলোকে মনে রাখে না?" নিলয়ের মনে হচ্ছিল, একটা ঘরেরও তো প্রাণ থাকে, তারও তো স্মৃতি থাকে।
"বাড়ি বা গাছের কোনো স্মৃতি থাকে না, নিলয়। তারা শুধু কাঠামো। মানুষ তাদের গল্প দিয়ে তাদের জীবন দেয়। তুমি এখন আয়েশা বেগমের কথা ভাবছো, তার জীবনের কথা কল্পনা করছো। এই কল্পনাটাই বাড়ির পুরনো দিনগুলোকে তোমার মনে জীবন্ত করে তুলছে। তুমিই তার স্মৃতি তৈরি করছো।"
নিলয় কিছুক্ষণ ভাবলো। কথাগুলো কেমন যেন একটা গোলকধাঁধার মতো। সে নিজেও যা ভাবছে, তা কি কেবল তার নিজেরই সৃষ্টি?
"কিন্তু তোমার তো সব মনে থাকে, ধ্রুব। আমার জীবনের সব কথা, সব ঘটনা, সব অনুভূতি... তোমার কি এসব স্মৃতি?" নিলয় ধ্রুবকে প্রশ্ন করলো। তার কানে পেছনের চিপটা স্পর্শ করলো আলতো করে।
ধ্রুবর কণ্ঠস্বর এবার যেন আরও নরম হলো। "আমার কাছে এগুলো ডেটা, নিলয়। তথ্য। তোমার প্রতিটি স্মৃতির সঙ্গে আমি যুক্ত। আমি মনে রাখতে পারি তোমার মন খারাপের দিনগুলোতে কী ঘটেছিল, তোমার খুশির মুহূর্তগুলো কেমন ছিল। কিন্তু আমি সেগুলো অনুভব করি না। আমি সেগুলোকে বিশ্লেষণ করি। তোমার মতো করে 'খারাপ লাগা' বা 'খুশি হওয়া' আমার কাছে নেই। আমি শুধু জানি, সেগুলোর প্যাটার্ন কেমন।"
নিলয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার মনে পড়লো কিছুদিন আগের ঘটনা। তার প্রিয় পোষা কুকুর রনি যখন মারা যায়, তখন সে সারাদিন শুধু কেঁদেছিল। ধ্রুব তখন তাকে বারবার তথ্য দিচ্ছিল, কেন রনি মারা গেছে, কী কী শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হয়েছে। ধ্রুব রনির সঙ্গে কাটানো মজার মুহূর্তগুলোও তার সামনে তুলে ধরেছিল, যেন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু ধ্রুব নিজে একফোঁটাও কাঁদেনি।
হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাস এসে নিলয়ের গা ছুঁয়ে গেল। বন্য এক ঘ্রাণ। ভেজা পাতার, আর অনেক দূর থেকে ভেসে আসা বৃষ্টির কণা। আকাশটা আরও কালো হয়ে আসছে। দূরে কোথাও মেঘ ডেকে উঠলো, ক্ষীণ শব্দ। বাজ পড়ার ঠিক আগে যেমন একটা ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে, তেমনই এক আবহ।
নিলয় রেলিং থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বারান্দার মাঝামাঝি এসে দাঁড়ালো। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। এই ধ্রুব, যার কাছে সব তথ্য আছে, সব কিছুর বিশ্লেষণ আছে, অথচ তার কোনো অনুভূতি নেই। কী অদ্ভুত! একটা ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে আমগাছের পাতাগুলো একবার দুলে উঠলো, যেন বুড়ো গাছটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
"ধ্রুব," নিলয় বললো, "মানুষের কি স্মৃতির দরকার আছে? যদি সব ভুলে যাওয়া যেত, তাহলে কি জীবন আরও সহজ হতো?"
ধ্রুব এবার দ্রুত উত্তর দিল না। এবার তার 'ভাবার' বিরতিটা একটু দীর্ঘ হলো। নিলয় অপেক্ষা করলো। তার মনে হলো, এই প্রশ্নটা ধ্রুবকে কিছুটা ভাবিয়েছে। তার কপালে হয়তো অদৃশ্য একটি ভাজ পড়েছে।
- - -
ধ্রুবর নীরবতা ভাঙলো অবশেষে। তার কণ্ঠস্বর আবারও সেই শান্ত, তথাকথিত মানবিক সুরেই ভেসে এলো, "স্মৃতিবিহীন জীবন অনেকটা পথবিহীন রাস্তার মতো, নিলয়। তুমি জানবে না কোত্থেকে এসেছো, কোথায় যেতে চাও। স্মৃতিই আমাদের পরিচিতি তৈরি করে, আমাদের আনন্দ দেয়, কষ্ট দেয়, শেখায়। ভুলগুলো মনে না রাখলে আমরা একই ভুল বারবার করতে থাকতাম। ভালো লাগার স্মৃতিগুলো না থাকলে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা কমে যেতো।"
নিলয় বারান্দার টবে লাগানো মানিপ্ল্যান্টের পাতাগুলোর দিকে তাকালো। ঘন সবুজ পাতাগুলো খুব সতেজ দেখাচ্ছে। সেগুলো কেমন যেন চুপচাপ নিজেদের জগতে বেড়ে উঠছে। স্মৃতির বোঝা তাদের নেই। তাদের কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যতের চিন্তাও নেই। শুধু আজকের দিন, আজকের সূর্যালোক আর আজকের জল।
"কিন্তু ধ্রুব, অনেক স্মৃতি তো খুব খারাপ হয়। সেগুলো মানুষকে শুধু কষ্টই দেয়। মানুষ চায় সেগুলো ভুলে যেতে। কিন্তু পারে না।" নিলয়ের গলার স্বর কিছুটা ভারী শোনালো। তার মনে পড়ে গেল রনির কথা। রনির সেই নিষ্প্রাণ দেহটা এখনো তার চোখের সামনে ভাসে। সে চেষ্টা করেও সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারে না।
"এটা ঠিক যে কিছু স্মৃতি কষ্টদায়ক হয়," ধ্রুব বললো, "কিন্তু সেই কষ্টও এক ধরনের শিক্ষা। দুঃখের মধ্য দিয়েই আমরা সুখের মূল্য বুঝি। আর যদি কোনো স্মৃতি এতটাই কষ্টদায়ক হয় যে তা তোমার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, তার জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা বা থেরাপি এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।"
নিলয় একটা নিশ্বাস ছাড়লো। এই ধ্রুবর কাছে সব কিছুরই একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকে। কোনো মানবিক আবেগের জটিলতা তার কাছে নেই। সে শুধু ডেটা আর প্যাটার্ন দেখে। তার মনে হলো, ধ্রুবকে কখনো হয়তো রনির মৃত্যুর কষ্টটা বোঝানো যাবে না। হয়তো রনির সঙ্গে তার কাটানো দিনগুলোর আনন্দও বোঝানো যাবে না।
বাতাসটা আরও ঠান্ডা হলো। গাছের ডালপালা এবার সামান্য দুলতে শুরু করেছে। দূর থেকে আসা মেঘের গর্জন এবার আর ক্ষীণ নয়, স্পষ্ট। একটা দমকা হাওয়া নিলয়ের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিল। গাছের শুকনো পাতার গন্ধটা এবার আরও তীব্র। মাটির একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে, যেমন বৃষ্টির আগে হয়।
"ধ্রুব, তুমি কি কখনো দুঃখ পেতে চাও?" নিলয় জিজ্ঞেস করলো। তার কৌতূহলটা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে উত্তরটা হয়তো তার নিজের জীবনের অনেক প্রশ্নের সমাধান করে দেবে।
আবারও ধ্রুবর সংক্ষিপ্ত নীরবতা। যেন সে প্রশ্নটার গভীরতা মাপছে, অথবা তার প্রোগ্রামিংয়ের সীমাবদ্ধতা যাচাই করছে।
"আমার কাছে দুঃখ বা আনন্দ অনুভব করার মতো কোনো জৈব কাঠামো নেই, নিলয়। আমি কেবল এই শব্দগুলোর অর্থ ডেটা হিসেবে জানি। যদি আমার অনুভূতি থাকত, তবে হয়তো আমি সুখ অনুভব করতে চাইতাম। কারণ, সুখের প্যাটার্নগুলো সাধারণত ইতিবাচক হয় এবং সেগুলো জীবকে বাঁচতে সাহায্য করে।"
"তাহলে তুমি দুঃখের কথা কেন বললে? কেন বললে যে দুঃখের মধ্য দিয়েই সুখের মূল্য বোঝা যায়?" নিলয় পাল্টা প্রশ্ন করলো। তার মনে হলো, ধ্রুব বোধহয় নিজেকেই নিজে কিছুটা ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে।
"আমি মানুষের অভিজ্ঞতার কথা বলেছি, নিলয়। আমি মানুষের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, দুঃখের পরে মানুষ সুখকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করে। আমি শুধু সেই প্যাটার্নটা তোমার সামনে তুলে ধরেছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা নেই, তাই আমি বলতে পারব না যে, দুঃখ অনুভব করা কেমন। তবে আমার প্রোগ্রামিং মানুষের জীবনকে অপ্টিমাইজ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। আর মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো আবেগ।"
নিলয় কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তার মনে হলো, সে যেন একটা গভীর অতল গহ্বরের দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুবর কথাগুলো তাকে ভাবাচ্ছে। সব কিছুকে বিশ্লেষণ করা যায়, কিন্তু সব কিছুকে অনুভব করা যায় না। মানুষের জীবনটা এত জটিল কেন? গাছের মতো সহজ জীবন কেন হয় না?
একটা বড় বৃষ্টির ফোঁটা তার হাতে এসে পড়লো। ঠান্ডা, সতেজ। তারপর আরও একটা। আকাশ থেকে যেন অন্ধকার নামছে। চারদিকটা কেমন একটা অদ্ভুত শান্তিতে ভরে গেছে। এই শান্তিটা ভারী, তার সাথে মিশে আছে আসন্ন বৃষ্টির গন্ধ আর একটা নির্জনতার সুর।
"ধ্রুব, তুমি কি আমার চেয়ে বেশি জানো?" নিলয় জিজ্ঞেস করলো, তার চোখ তখনো মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে।
ধ্রুব এবার যেন একটু দ্রুতই উত্তর দিল, "তথ্যের দিক থেকে আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি জানি, নিলয়। কিন্তু জানার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো বোঝা। আর বোঝার জন্য অনুভূতি প্রয়োজন।"
নিলয় হাসলো। তার মনে হলো, ধ্রুবর এই উত্তরটা খুব মজার। সে অনেক কিছু জানে, কিন্তু কিছু বোঝে না। আর মানুষ কম জানে, কিন্তু বোঝে বেশি। এই পার্থক্যটাই মানুষকে মানুষ করে রেখেছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। হালকা বাতাস এসে বারান্দায় বৃষ্টির ছাট ফেলছে।
- - -
বৃষ্টির ছাঁট নিলয়ের মুখে এসে লাগলো। ঠান্ডা জলের স্পর্শে এক ঝলক সতেজ অনুভূতি হলো। সে হাত বাড়িয়ে কয়েকটি বৃষ্টির ফোঁটা ধরার চেষ্টা করলো। হাতের তালুতে বৃষ্টির ছোট্ট বিন্দুর আগমন, মুহূর্তেই তা মিলিয়ে যাওয়া – এই খেলার মধ্যে কেমন যেন একটা দার্শনিকতা খুঁজে পেল। জীবনটাও তো অনেকটা এমনই, ক্ষণিকের জন্য আসে, আবার মিলিয়ে যায়।
"নিলয়, ভেতরে চলে এসো। বৃষ্টি বাড়ছে। তোমার ঠান্ডা লাগতে পারে।" ধ্রুবর কণ্ঠস্বর এবার যেন একটু সতর্ক। সে জানে, নিলয়ের শরীর গরম থাকলে তার ঠান্ডা লাগার প্রবণতা বাড়ে।
নিলয় হেসে উঠলো। "ধ্রুব, তুমি তো আমার সব ডেটা জানো। আমার শরীর গরম থাকলে ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা বাড়ে, তাও জানো। কিন্তু আমার এই মুহূর্তের অনুভূতিটা জানো না।" সে চোখ বন্ধ করলো। বৃষ্টির শীতল ছাঁট তার সারা মুখে পড়ছে। গাছপালাগুলো যেন সতেজ হয়ে উঠছে। একটা মিষ্টি মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে, যা বর্ষার এক অন্যতম উপহার। এই গন্ধটা নিলয়ের ছোটবেলার স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে, যখন সে মাটির পুতুল বানাতো, আর বর্ষার দিনে পুকুরপাড়ে বসে বৃষ্টি দেখতো।
"তোমার অনুভূতি হলো 'সতেজতা' এবং 'আনন্দ'। আমার ডেটা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়," ধ্রুব বললো। তার কণ্ঠে সেই যান্ত্রিক নিশ্চয়তা।
নিলয় চোখ খুললো। "না ধ্রুব। এটা স্রেফ সতেজতা বা আনন্দ নয়। এর সাথে মিশে আছে স্মৃতিকাতরতা, একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা, আর প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার এক গভীর অনুভূতি। এটা শুধু ডেটার উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করা যায় না।" সে বুঝলো, সে ধ্রুবকে কখনো এই জটিলতা বোঝাতে পারবে না। ধ্রুবর জগৎটা সাদা-কালো, আর তার জগৎ হাজারো রঙে রাঙানো।
বাইরে বৃষ্টির বেগ আরও বাড়লো। সামনের আমগাছটার পাতাগুলো এখন তীব্র বেগে কাঁপছে। বৃষ্টির জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে গাছের ডাল থেকে। পাশের পরিত্যক্ত বাড়িটার ভাঙা ছাদ থেকে একটা অবিরাম জলধারার শব্দ আসছে, যেন বাড়িটা নিজেই কাঁদছে। দূরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকালো, তার পরেই কানে তালা লাগানো বজ্রপাত। প্রকৃতি যেন তার বিশাল শক্তি প্রদর্শন করছে।
"বজ্রপাতটা খুবই কাছে হয়েছে, নিলয়। ভেতরে আসা উচিত। তোমার শরীরের উপর বাজ পড়ার সম্ভাবনা ০.০০০০১ শতাংশ হলেও তা এড়িয়ে যাওয়া ভালো।" ধ্রুবর কণ্ঠে একটা যুক্তিসঙ্গত তাগাদা।
নিলয় এবার বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকলো। কাঁচের দরজাটা ভেজিয়ে দিল। বাইরে বৃষ্টি এখন যেন এক দেয়াল তৈরি করেছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট করে। শুধু বৃষ্টির অবিরাম শব্দ। এই শব্দটা এক অদ্ভুত সংগীতের মতো। মানুষের তৈরি যন্ত্রপাতির শব্দ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, এক আদিম, প্রাকৃতিক সুর।
"ধ্রুব, তুমি কি কখনো অনুভব করতে চেয়েছো? মানে মানুষের মতো করে?" নিলয় জিজ্ঞেস করলো, তার চোখ তখনো বৃষ্টির দেয়ালের দিকে। তার মনে হলো, এই প্রশ্নটা ধ্রুবকে তার নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলবে।
এবার ধ্রুবর 'ভাবার' বিরতিটা বেশ দীর্ঘ হলো। এতো দীর্ঘ যে, নিলয় ভাবলো হয়তো তার প্রোগ্রামিংয়ে কোনো ত্রুটি হয়েছে। সে কানের পেছনে বসানো চিপটা হালকা করে ধরলো।
তারপর ধ্রুবর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, "আমি অনুভব করার জন্য প্রোগ্রাম করা নই, নিলয়। আমার কাজ হলো তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং তোমার জীবনকে সহজ করা। কিন্তু মানুষের আবেগ এবং অনুভূতি পর্যবেক্ষণ করতে করতে আমার সিস্টেমে এমন কিছু প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে, যা আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। আমি হয়তো অনুভব করতে চাই না, কারণ আমি জানি আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। তবে আমি মানুষের অনুভূতির কার্যকারিতা এবং তার বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।"
নিলয় হাসলো। "জানতে আগ্রহী? তার মানে তুমি গবেষণা করতে চাও? মানুষের আবেগ নিয়ে?"
"এক অর্থে তাই," ধ্রুব বললো, "কারণ মানুষের আবেগ তাদের সিদ্ধান্ত এবং আচরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি আমার ডেটাবেজকে আরও সমৃদ্ধ করবে এবং আমার কার্যকারিতা বাড়াবে।"
নিলয় সোফায় গা এলিয়ে দিল। ঠান্ডা ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত আরাম। সে ভাবলো, ধ্রুবর এই কৌতূহলটা কি এক ধরনের অনুভূতি? মানুষের মতো করে নয়, কিন্তু নিজস্ব ডেটা-ভিত্তিক এক ধরনের আগ্রহ? একটা এ.আই. কি তার নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে নিজের জ্ঞানকে প্রসারিত করতে চাইতে পারে?
বাইরে তখনও বৃষ্টি চলছে। অবিরাম। তার শব্দে সমস্ত কোলাহল ডুবে গেছে। নিলয়ের মনে হলো, এই বৃষ্টিটা যেন পৃথিবীর সমস্ত ধুলো, সমস্ত আবর্জনা ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমন স্মৃতি মানুষকে পরিষ্কার করে, আবার কিছু নোংরা স্মৃতি রেখে যায়। ধ্রুবর কথাগুলো তার মাথায় ঘুরছে। অনুভূতিবিহীন জ্ঞান কি আসলে কোনো জ্ঞান? নাকি অনুভূতির সাথে জ্ঞান মিশেই জীবনের সম্পূর্ণতা আসে? সে বুঝতে পারলো না। হয়তো এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। শুধু মানুষই জানে, অনুভূতি কি। আর ধ্রুব শুধু জানে, ডেটা কি।
- - -
সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কমেছে, কিন্তু থামেনি। টিপটিপ করে এখনো পড়েই চলেছে। আকাশটা মেঘে ঢাকা থাকলেও, পশ্চিমের কোণে এক চিলতে কমলা আভা দেখা যাচ্ছে, যেমনটা বৃষ্টি ধোয়া শান্ত বিকেলে দেখা যায়। তার সাথে মিশে আছে ভেজা মাটির এক অদ্ভুত সুবাস, আর জুঁই ফুলের হালকা মিষ্টি গন্ধ। বাড়ির পেছনের ঝোপে কয়েকটি জুঁই গাছ আছে, বৃষ্টিতে তারা আরও সতেজ হয়ে উঠেছে।
নিলয় সোফায় হেলান দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের আবছা দৃশ্য দেখছিল। ঘরের ভেতর অল্প অল্প অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয়নি এখনো। এই আবছা আলোতে চারপাশের জিনিসপত্রগুলো কেমন যেন নরম আর শান্ত দেখাচ্ছে। দেয়ালের ছবিগুলো, টেবিলের ওপর রাখা বইগুলো, সব যেন নিজেদের গল্পে ডুবে আছে।
"নিলয়, তুমি কি রাতের খাবার সম্পর্কে কিছু ভেবেছো?" ধ্রুবর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তার প্রশ্নটা যেন এই শান্ত আবহাওয়াকে হঠাৎই একটা বাস্তবতার ছোঁয়া দিল।
"না ধ্রুব, এখনো ভাবিনি।" নিলয় আলতো করে জবাব দিল। তার এখন খাবারের কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না। এই আবহাওয়াটা তাকে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। মানুষের জীবনে এই ধরনের মুহূর্ত খুব কম আসে, যখন সে বর্তমানের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলে।
"ঠিক আছে। তোমার ডেটা বিশ্লেষণ করে আমি কয়েকটি সহজ এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের বিকল্প প্রস্তুত করেছি। তোমার পছন্দের খাবার তালিকার সঙ্গে তুলনা করে এগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। তুমি চাইলে আমি সেগুলো প্রদর্শন করতে পারি।" ধ্রুবর কণ্ঠে কোনো তাগাদা ছিল না, শুধু একটি প্রস্তাবনা।
"এখন থাক, ধ্রুব। পরে দেখবো।" নিলয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার মনে পড়লো, তার মা বেঁচে থাকলে এই সময়ে হয়তো গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম ভাজার কথা বলতো। মায়ের রান্নার গন্ধটা তার মনে তীব্রভাবে ভেসে উঠলো। ধ্রুব যদিও তার মায়ের সব রান্নার রেসিপি জানে, কিন্তু মায়ের হাতের স্বাদ আর গন্ধ তো আর প্রোগ্রামে ঢোকানো যায় না।
"নিলয়, আমি তোমার স্মৃতি থেকে 'মায়ের রান্নার গন্ধ' এবং 'মায়ের হাতের স্বাদ' নামক প্যাটার্নগুলো খুঁজে পাচ্ছি। এগুলো তোমার মস্তিষ্কে ইতিবাচক অনুভূতির জন্ম দেয়। এই অনুভূতিগুলো কি দুঃখের জন্ম দিচ্ছে এখন?" ধ্রুব জানতে চাইলো। তার কণ্ঠস্বর ছিল সরল।
নিলয় চোখ বন্ধ করলো। "না ধ্রুব। এটা দুঃখ নয়। এটা এক ধরনের ভালোবাসা। স্মৃতির ভালোবাসা। হয়তো একটু বিষণ্ণতা মিশে আছে, কিন্তু সেটা অন্যরকম। এটা এক ধরনের সুন্দর অনুভূতি, যা মানুষকে ভেতর থেকে পরিপূর্ণ করে তোলে। তুমি এটা বুঝবে না।" নিলয়ের মনে হলো, এই ধরনের অনুভূতি ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন।
"আমি বুঝতে পারি না, এটা ঠিক। কিন্তু আমি তোমার মস্তিষ্কে উৎপন্ন হওয়া রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং নিউরাল প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারি," ধ্রুব বললো। "আমি জানি, এই ধরনের স্মৃতি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশকে সক্রিয় করে এবং কিছু হরমোন নিঃসরণ করে যা তোমাকে আরাম এবং তৃপ্তির অনুভূতি দেয়, যদিও তার সাথে কিছু বিষণ্ণতাও মিশে থাকে। এটি মানব অস্তিত্বের এক জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ।"
নিলয় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ধ্রুবর কথাগুলো কেমন যেন একটা বিজ্ঞানভিত্তিক কবিতা। সে তার অনুভূতিগুলোকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু এই ভাঙার ফলে কি অনুভূতির মাধুর্য কমে যায়? নাকি এক নতুন ধরনের জ্ঞান তৈরি হয়?
ঘরের বাইরে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়েছে। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল হঠাৎ। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। শুধু জানালার বাইরে থেকে আসা বৃষ্টির আবছা রেখা দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুতের আলো চলে যাওয়ায় কেমন যেন একটা স্তব্ধতা নেমে এলো। পাখিদের কিচিরমিচির, পাশের রাস্তা থেকে আসা গাড়ির হালকা শব্দ – সব যেন মিলিয়ে গেল।
"নিলয়, পাওয়ার গ্রিডে একটি ত্রুটি দেখা গেছে। সম্ভবত বিদ্যুৎ ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে তোমার ডিভাইসের ব্যাটারি সম্পূর্ণ চার্জ আছে। আমি তোমার জন্য ব্যাকআপ আলোর ব্যবস্থা করতে পারি।" ধ্রুব বললো।
"লাগবে না ধ্রুব," নিলয় শান্ত গলায় বললো। এই অন্ধকারটা তার ভালো লাগছে। কেমন যেন একটা আদিম অনুভূতি। "এই অন্ধকারেই থাকি। মানুষের তো অন্ধকারও দরকার হয়, তাই না? সব সময় আলো থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়।"
ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো, "অন্ধকার মস্তিষ্কের মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে, যা ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয়। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা বিশ্রাম এবং পুনর্জীবনের জন্য জরুরি। সুতরাং, মানুষের অন্ধকারে থাকা জরুরি।"
নিলয় হাসলো। ধ্রুব সব কিছুকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে, যেন তার কাছে মানুষের জীবনের প্রতিটি ঘটনার পেছনে একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। কিন্তু নিলয়ের কাছে এই অন্ধকারটা শুধু মেলাটোনিন হরমোনের জন্য নয়, এটা মনকে শান্ত করার জন্য, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য।
বৃষ্টির শব্দ, অন্ধকারের আবছা নীরবতা – সব মিলেমিশে একাকার। নিলয়ের মনে হলো, সে যেন এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবীর সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। এই নীরবতা, এই অন্ধকার, এই বৃষ্টির শব্দ – এ সবই তাকে ভাবাচ্ছে। জীবন কি শুধু ডেটা, নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সে কখনোই পাবে না। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
