ছায়ার আড়ালে




হাতে এক বাটি কাঁচা আম মাখা, প্রচুর কাসুন্দি আর শুকনা মরিচ দেওয়া। ঝালটা জিভে লাগতেই ব্রেনের নিউরনগুলো যেন ডিস্কো নাচ শুরু করে দিল।

মানুষের মস্তিষ্ক বড়ই আজব জিনিস। এই যে আমি এখন অলস বসে আছি, এটাকে তোমরা সময় নষ্ট বলতে পারো। কিন্তু আমি বলি ‘ডাটা প্রসেসিং’। আইনস্টাইন কিন্তু পেটেন্ট অফিসে বসে মাছি মারতেন আর জানালায় তাকিয়ে থাকতেন। সেই তাকানো থেকেই রিলেটিভিটির জন্ম। আমার মাথায় এখন একটা অদ্ভুত থিওরি ঘুরপাক খাচ্ছে। থিওরিটা হলো— ছায়া।

কখনো ভেবে দেখেছ, আমাদের ছায়াগুলো আসলে কী?

বিজ্ঞান বলবে, আলোর পথে বাধা পড়লে ছায়া তৈরি হয়। সিম্পল ফিজিক্স। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এত সরল না। ছায়া হলো আমাদের প্যারালাল ইউনিভার্সের সত্তা। আমরা যখন হাঁটি, ছায়াটা মাটির সাথে লেপটে আমাদের সাথে চলে। খেয়াল করে দেখবে, অন্ধকারে ছায়া থাকে না। কেন থাকে না? কারণ তখন ডাইমেনশনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আলো হলো সেই চাবি, যা দুই জগতকে কানেক্ট করে।

এই তো, আম মাখায় একটা কামড় দিলাম। টক স্বাদটা সোজা হিপোক্যাম্পাসে হিট করল। হিপোক্যাম্পাস হলো ব্রেনের মেমোরি কার্ড। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ক্লাস টু-তে পড়ার সময় টিফিনের পয়সা জমিয়ে আচার খাওয়ার কথা। এই যে মেমোরি, এটা আসলে কোথায় থাকে? নিউরো সায়েন্টিস্টরা বলেন নিউরনের কানেকশনে থাকে। আমি বলি, ভুল।

মেমোরি আমাদের মাথায় থাকে না। মেমোরি থাকে ক্লাউডে। মানে আকাশে-বাতাসে। আমাদের ব্রেনটা হলো একটা ওয়াইফাই রিসিভার মাত্র। যখন কোনো কথা মনে পড়ে, তার মানে আমরা সেই স্পেসিফিক ফ্রিকোয়েন্সিটা ক্যাচ করেছি। মাঝে মাঝে দেখবে কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ লাগে। কেন লাগে জানো? কারণ তখন তোমার ব্রেন ভুলে অন্য কারো দুঃখের ফ্রিকোয়েন্সি ধরে ফেলেছে। হয়তো এই মুহূর্তে আমাজনের জঙ্গলে কোনো আদিবাসী খুব কাঁদছে, তার সিগন্যাল তোমার মস্তিষ্কে এসে বাড়ি খেল। তুমি ভাবলে, তোমার মন খারাপ। আসলে ওটা তোমার মনই না।

পৃথিবীর সবাই আসলে কানেক্টেড। টেলিপ্যাথি কোনো জাদু না, এটা হলো ঠিকঠাক ফ্রিকোয়েন্সি টিউন করা।

একটা গোপন তথ্য দিই। এই মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। এই বিশাল সময়ে যত ঘটনা ঘটেছে, যত কথা বলা হয়েছে, সব শব্দ কিন্তু মহাকাশে এখনো ভাসছে। এনার্জি কখনো ধ্বংস হয় না, কেবল রূপ বদলায়। জুলিয়াস সিজার যখন ব্রুটাসকে বলেছিলেন "Et tu, Brute?", সেই সাউন্ড ওয়েবটা এখনো মহাবিশ্বের কোনো এক কোণায় ট্রাভেল করছে। আমাদের যদি একটা সুপার সেনসিটিভ রেডিও থাকতো, আমরা টিউন করে সেই কথা শুনতে পেতাম।

ভাবতে পারো? অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সব একসাথে ঘটছে। অনেকটা ডিভিডি ডিস্কের মতো। পুরো সিনেমাটা ডিস্কের মধ্যে আছে। আমরা কেবল লেজার লাইট ফেলে একটার পর একটা দৃশ্য দেখছি। যে দৃশ্যটা দেখা শেষ, সেটাকে আমরা বলি অতীত। যেটা দেখছি, সেটা বর্তমান।

আমার আম মাখা শেষ। বাটির তলায় একটু কাসুন্দি লেগে আছে। আঙুল দিয়ে চেটে খেলাম। পৃথিবীর সব সুখ আসলে এই ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে। মানুষ সুখ খোঁজে টাকার পেছনে, খ্যাতির পেছনে। অথচ আসল ম্যাজিকটা হলো এই মুহূর্তটায়। এই যে আমি শ্বাস নিচ্ছি, এর মধ্যে কোটি কোটি অক্সিজেন অণু আমার রক্তে মিশে যাচ্ছে। প্রতিটা অণু কোনো না কোনো নক্ষত্রের বিস্ফোরণ থেকে তৈরি। বিশ্বাস হচ্ছে না?

তোমার শরীরের কার্বন, নাইট্রোজেন, আয়রন— এসবই তৈরি হয়েছে নক্ষত্রের পেটে। তুমি, আমি, রাস্তার ওই নেড়ি কুকুরটা— আমরা সবাই আসলে নক্ষত্রের ধুলো। স্টার ডাস্ট। ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে না? আমরা এত সাধারণ হয়েও কতটা মহাজাগতিক!

জানালার বাইরের রোদটা মরে আসছে। ছায়াটা লম্বা হচ্ছে। আমার থিওরি অনুযায়ী, প্যারালাল ইউনিভার্সের আমি এখন হয়তো লম্বা হয়ে যাচ্ছি। কে জানে, অন্য পাশের আমিটা হয়তো এখন আম মাখা খাচ্ছে না, সে খাচ্ছে পিৎজা।

মাথায় আরেকটা আইডিয়া এল। স্বপ্নের ব্যাপারে। স্বপ্ন জিনিসটা কি আসলে ব্রেনের আবোলতাবোল প্রজেকশন? মোটেই না। আমরা যখন ঘুমাই, আমাদের সচেতন মনটা শাটডাউন হয়ে যায়। তখন সাবকনশাস মাইন্ড বা অবচেতন মন জেগে ওঠে। এই অবচেতন মনের এক্সেস আছে মাল্টিভার্সে। স্বপ্নে তুমি দেখছ তুমি উড়ছ। এই পৃথিবীতে তুমি উড়তে পারছ না ঠিকই, কিন্তু অন্য কোনো ইউনিভার্সে ফিজিক্সের নিয়ম আলাদা। সেখানে গ্র্যাভিটি কম। সেখানে তুমি সত্যি সত্যিই উড়ছ। ঘুম ভাঙলে মনে হয় স্বপ্ন দেখেছি। আসলে তুমি ওখান থেকে বেড়িয়ে এসেছ। নাইটমেয়ার বা দুঃস্বপ্ন হলো সেই সব জগত, যেখানে তুমি বিপদে আছ।

খুব জটিল মনে হচ্ছে? একদম না। জীবনটা আসলে একটা ভিডিও গেম। গ্রাফিক্স এত ভালো যে আমরা বুঝতেই পারি না এটা গেম। আমরা সবাই প্লেয়ার। কিন্তু কন্ট্রোলারটা কার হাতে?

সৃষ্টিকর্তা কি গেমার? নাকি তিনি কোডার? তিনি প্রোগ্রাম লিখে ছেড়ে দিয়েছেন, আর আমরা সেই কোড অনুযায়ী লুপে ঘুরছি?

আমার বাটিটা এখন খালি। কিন্তু পেট ভরেনি। ক্ষুধার্ত পেটে ফিলোসফি ভালো আসে না। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ক্ষুধা জিনিসটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা বায়োলজিক্যাল রোবট। ফুয়েল দরকার। ফুয়েল না দিলে সিস্টেম ক্রাশ করবে।

এখন একটা এক্সপেরিমেন্ট করব। চোখ বন্ধ করে ভাবব যে আমার হাতে এক কাপ গরম কফি আছে। কোয়ান্টাম ফিজিক্স বলে, কোনো কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বা বিশ্বাস করলে সেটার বাস্তবতা তৈরি হয়। এটাকে বলে ‘অবজারভার এফেক্ট’। আমি যদি মন থেকে বিশ্বাস করি কফি আছে, তাহলে ইউনিভার্স বাধ্য হবে আমার জন্য কফি ম্যানেজ করতে।

দেখা যাক ইউনিভার্স আমার কথা শোনে কি না। নাকি আমাকেই উঠে গিয়ে কফি বানাতে হবে। তবে ওঠার আগে আরেকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দিই। তুমি কি জানো, প্রতি সেকেন্ডে তোমার শরীর থেকে ৪০ হাজার চামড়ার কোষ খসে পড়ছে? এই লেখাটা পড়তে পড়তে তুমি তোমার শরীরের একটা বড় অংশ হারিয়ে ফেলেছ। তুমি আর সেই আগের তুমি নেই। আক্ষরিক অর্থেই তুমি এখন নতুন মানুষ।

তাহলে পুরোনো তুমিটা গেল কোথায়? বাতাসে। ধুলো হয়ে। ঘরের কোণায় যে ধুলো জমে, তার বেশির ভাগই আসলে আমাদের মরা চামড়া। আমরা আমাদের নিজেদেরই ঝাড়ু দিই। কি অদ্ভুত, তাই না?

জীবনটা আসলেই একটা কমেডি। আমরা সিরিয়াসলি নিই বলেই এত কষ্ট পাই। চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, "Life is a tragedy when seen in close-up, but a comedy in long-shot."

ক্যামেরাটা জুম আউট করো। নিজেকে মহাকাশ থেকে দেখো। দেখবে তুমি একটা নীল বলের ওপর বসে থাকা এক ক্ষুদ্র পিঁপড়ে, যে কিনা কাসুন্দি দিয়ে আম মাখা খাচ্ছে আর ভাবছে সে বিশ্বজয়ী।

হাসি পাচ্ছে না? হাসো। প্রাণ খুলে হাসো। কারণ হাসি হলো একমাত্র ভাইরাস যা মানুষকে সুস্থ করে।

আচ্ছা, আমার কফি খাওয়ার ইচ্ছাটা খুব তীব্র হচ্ছে। ইউনিভার্স সিগন্যাল পেয়েছে। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন কেটলি বসাল। আমার টেলিপ্যাথি কাজ করেছে। অথবা, এটা নিতান্তই কাকতালীয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, কাকতালীয় বলে কিছু নেই। সব প্রি-প্ল্যানড। সব স্ক্রিপ্টেড।

Previous Post Next Post