অমূল্য জঞ্জাল




নীরা হাই তুলল। বেশ বড় করে হাই। অথচ ওর ঠিক চোখের সামনেই আমি টেবিলের ওপর একটা নীল রঙের হীরের আংটি রেখেছি। সাইজে ওটা প্রায় কবুতরের ডিমের সমান। একসময় এই জিনিসের জন্য রাজারা যুদ্ধ করত, ভাই ভাইকে বিষ খাওয়াত। আর এখন? নীরা আংটিটা বাঁহাতের তর্জনী দিয়ে টুস করে টোকা দিয়ে সরিয়ে দিল।

"বোরিং," নীরা বলল। "রাফি, তুমি বড্ড সেকেলে। আবার সেই হীরে? গত সপ্তাহেই তো প্রিন্ট করলাম এক বালতি। ওগুলো দিয়ে এখন আমি অ্যাকুয়ারিয়ামের পাথর সাজিয়েছি।"

আমি হাসলাম। হাসিটা একটু করুণ। সালটা ২০৯৫। এখন আর কাউকে কিছু দিয়ে চমকে দেওয়া যায় না।

পকেটে হাত দিয়ে আমার ন্যানো-ফ্যাব্রিকেটরটা বের করলাম। দেখতে অনেকটা পুরনো আমলের স্মার্টফোনের মতো, কিন্তু এর ক্ষমতা অসীম। বাতাসে ভাসমান কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের অণুগুলোকে ধরে ইচ্ছেমতো সাজিয়ে নেওয়া—ব্যস, যা চাইবেন তাই হাজির। হীরে চান? কার্বনের অণুগুলোকে একটু শক্ত করে সাজিয়ে দিলেই হলো। সোনা চান? প্রোটন সংখ্যা অ্যাডজাস্ট করে নিন।

টেবিলে রাখা হীরের আংটিটা তুলে নিয়ে আমি 'ডি-ম্যাটেরিয়ালাইজ' বাটন চাপলাম। চোখের পলকে কঠিন হীরেটা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল। ওটা এখন রিসাইকেল বিনে জমা হয়েছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর ওটা দিয়েই আমি একবাটি গরম সুপ প্রিন্ট করব।

ভাবতে অবাক লাগে, একসময় মানুষ বলত—"এটা আমার বাড়ি, ওটা আমার গাড়ি।"

'আমার' শব্দটা এখন ডিকশনারির সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় শব্দ। সম্পত্তির ধারণাটাই আমাদের মাথা থেকে ডিলিট হয়ে গেছে। জমিয়ে রাখার মানে কী? চুরির ভয়ও নেই। চোর এসে কী নেবে? আমার ঘরের টিভি? ও তো চাইলে নিজের পকেটের মেশিন দিয়েই এর চেয়ে ভালো টিভি বানিয়ে নিতে পারে। পুলিশ এখন মিউজিয়ামে বসে মাছি মারে। ক্রাইম বলতে এখন আর কিছু নেই, অন্তত চুরির দায়ে কেউ জেলে যায় না।

"কী ভাবছ?" নীরা জিজ্ঞেস করল।

"ভাবছি অভাব নিয়ে," আমি বললাম। "মানুষের জীবনে কোনো অভাব নেই। এটাই কি সবচেয়ে বড় অভাব না?"

নীরা কফি মগে চুমুক দিল। এই কফিটাও সিন্থেটিক, ল্যাবে বানানো, কিন্তু স্বাদ একদম আদিম অ্যারাবিকা কফিখানার মতো। ও বলল, "ফিলোসফি ঝেড়ো না তো। আজ আমার মন খারাপ। আমাকে এমন কিছু দাও যা আমার কাছে নেই।"

আমি ফ্যাসাদে পড়লাম। যার কাছে আলাদিনের দৈত্যের চেয়েও শক্তিশালী মেশিন আছে, তাকে আমি কী দেব? পৃথিবীর সব দামি গাড়ি, বাড়ি, গয়না—সবই তো এখন আবর্জনার সমান। সোনা আর মাটির দরের কোনো পার্থক্য নেই। লোকে এখন সম্পদের কাঙাল না, অভিজ্ঞতার কাঙাল।

হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এল।

আমি মেশিনটা পকেটে রেখে দিলাম। তারপর নিজের জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বের করলাম। কাগজটা আসল গাছের ছাল থেকে বানানো না, রিসাইকেল্ড ফাইবার। কলম বের করে খসখস করে কিছু একটা আঁকলাম।

খুবই জঘন্য একটা ছবি। একটা মানুষ আর একটা গাছ। মানুষের হাতটা অতিরিক্ত লম্বা, গাছের ডালপালা সব বাঁকা। কোনো জ্যামিতিক হিসাব নেই, পারফেকশন নেই। ন্যানো-মেশিন এক ন্যানোমিটারও ভুল করে না, কিন্তু আমার এই আঁকায় ভুলে ভরা।

কাগজটা ছিঁড়ে আমি নীরার দিকে এগিয়ে দিলাম।

"এটা কী?" নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকাল।

"একটা ভুল," আমি বললাম। "মেশিন দিয়ে তুমি পারফেক্ট মোনালিসা প্রিন্ট করতে পারবে এক সেকেন্ডে। কিন্তু এই জঘন্য ছবিটা মেশিন আঁকতে পারবে না। কারণ মেশিন ভুল করতে জানে না। এই আঁকাবাঁকা লাইনগুলো, এই যে কালির দাগটা একটু লেপটে গেল—এটা ইউনিক। পৃথিবীতে এই একটাই পিস আছে। তুমি চাইলেও এটা আর হুবহু কপি করতে পারবে না।"

নীরার চোখ চকচক করে উঠল। হীরের আংটি দেখে ওর যে ভাবান্তর হয়নি, এই বাজে ছবিটা দেখে তা হলো। ও যত্ন করে কাগজটা ধরল, যেন ওটা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি রত্ন।

"এটা... এটা একান্তই আমার?" নীরা ফিসফিস করে বলল।

"হ্যাঁ," আমি বললাম। "ওটা তোমার। কপিরাইট ফ্রি না, ওপেন সোর্স না। একান্তই তোমার ব্যক্তিগত।"

নীরা হাসল। সেই হাসিতে মেশিনের যান্ত্রিকতা নেই।

বুঝলাম, আগামী দিনের পৃথিবীটা অদ্ভুত। যখন আমাদের সব থাকবে, তখন আমাদের আসলে কিছুই থাকবে না। তখন আমরা খুঁজে বেড়াব একটুখানি ভুল, একটুখানি অসম্পূর্ণতা। সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। পারফেকশনের ভিড়ে ইম্পারফেক্ট হওয়ার বিলাসিতাই হবে নতুন আভিজাত্য।

হীরের আংটিটা রিসাইকেল হয়ে ততক্ষণে সুপ হয়ে গেছে। আমি ওয়েটারকে ইশারা করলাম। খিদে পেয়েছে।

Previous Post Next Post