ছায়া-মানব




মোবারক সাহেবের পকেটে সেদিন ঠিক সাতাশ টাকা ছিল। পকেটে সাতাশ টাকা থাকা কোনো বিশেষ ঘটনা নয়। বিশেষ ঘটনা হলো, তিনি ঠিক করলেন এই সাতাশ টাকা দিয়ে তিনি একটা বাড়তি ছায়া কিনবেন।

নিউ মার্কেটের সামনে ফুটপাতে যে লোকটা বসে, তার কাছে বিড়ালের খাঁচা, তাসের প্যাকেট, পুরনো ম্যাগাজিন—সব পাওয়া যায়। মোবারক সাহেব লোকটার কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, "ছায়া আছে?"

লোকটা অবাক হলো না। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের অবাক হতে নেই। সে উদাস গলায় বলল, "কার ছায়া লাগবে? মানুষের না পশুর?"
"মানুষের।"
"নিজের ছায়া থাকতে আরেকটা দিয়ে কী করবেন?"
মোবারক সাহেব একটু ভাবলেন। ঠিকই তো। কী করবেন? তিনি ঠিক জানেন না। "লাগবে। একটা হলেই চলবে।"

ফুটপাতের লোকটা হাই তুলে বলল, "দাম পড়বে। একশ।"
"আমার কাছে সাতাশ টাকা আছে।"
"সাতাশ টাকায় কুকুরের ছায়াও হয় না। যান।"

মোবারক সাহেব মন খারাপ করে হাঁটা দিলেন। মানুষের মন অদ্ভুত। যা তার নেই, তা তার চাই-ই চাই। যা তার আছে, সেটার দিকে সে ফিরেও তাকায় না। মোবারক সাহেবের নিজের ছায়াটা বেশ চমৎকার। লম্বা, ঘন কালো। বিকেলের রোদে সেটা বাড়তে বাড়তে কখনো কখনো দৈত্যের মতো হয়ে যায়। তবু তার আরেকটা ছায়া লাগবে।

পৃথিবীতে অদ্ভুত ঘটনার অভাব নেই। অভাব শুধু সেগুলো দেখার মতো চোখের। মোবারক সাহেব হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখলেন, একটা লোক তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, কিন্তু লোকটার কোনো ছায়া নেই। ভরদুপুর। কড়া রোদ। অথচ লোকটার পায়ের নিচে কিচ্ছু নেই। যেন সে মাটির কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে ভাসছে।

মোবারক সাহেব দৌড়ে লোকটাকে ধরলেন। লোকটার নাম 'আবিদ'। সে একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করে।
"ভাই, আপনার ছায়া কই?" মোবারক সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন।
আবিদ সাহেব বিরক্ত হলেন। "ছায়া দিয়ে কী হবে? ওটা একটা বাড়তি বোঝা। ওজন নেই, আয়তন নেই, তবু পিছু ছাড়ে না।"
"আপনি বিক্রি করেছেন?"
"না। হারিয়ে ফেলেছি।"
"কোথায়?"
"মনে নেই। মাস ছয়েক আগে একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি, নেই।"

মোবারক সাহেব অবাক হলেন। ছায়াও হারায়! এটা তো দারুণ তথ্য। ছায়া আসলে কী? এটা তো কোনো বস্তু না। এটা আলোর অনুপস্থিতি। যেখানে ফোটন কণা পৌঁছাতে পারে না, সেটুকুই অন্ধকার। সেই অন্ধকার হারায় কী করে?

আবিদ সাহেব বললেন, "হারানোর পর থেকে ভালোই আছি। শরীরটা হালকা লাগে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি না।"
"দুঃস্বপ্ন দেখেন না?"
"না। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের ভেতরের যে অন্ধকার, সেটাই তার 'শ্যাডো'। আমার তো শ্যাডোই নেই, অন্ধকার আসবে কোত্থেকে?"

মোবারক সাহেবের লোভ হলো। তারও ছায়ামুক্ত হতে ইচ্ছে করল। তিনি আবিদ সাহেবকে বললেন, "ভাই, আমার ছায়াটা নেবেন? ১০০ টাকা দিলেই হবে।"
আবিদ সাহেব রাজি হলেন না। যার একবার ছায়া হারায়, সে আর ওমুখো হয় না।

মোবারক সাহেব বাসায় ফিরলেন। আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। নিজেকে দেখলেন। তারপর নিজের ছায়াটার দিকে তাকালেন। এই যে কালো অবয়বটা, এটা আসলে কে? এটা কি আসলেই তিনি? নাকি তার ভেতরের অন্য কেউ, যে আলোর ভয়ে তার পায়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছে?

তিনি ঠিক করলেন, ছায়াটাকে তিনি নিজেই তাড়াবেন।
রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে গেলেন। ছায়া নেই। কিন্তু মোবারক সাহেবও তো নেই। অন্ধকারে সবাই ছায়াহীন।
তিনি বাতি জ্বাললেন। দেয়ালের ওপর তার প্রকাণ্ড ছায়াটা নড়েচড়ে বসল। যেন সে হাসছে।

পরদিন মোবারক সাহেব আবার নিউ মার্কেটে গেলেন। সেই ফুটপাতের লোকটার কাছে।
"ভাই, ছায়া বিক্রি করব। আমারটা।"
লোকটা এবারও অবাক হলো না। "কত চান?"
"একশ।"
"পঞ্চাশ দেবো।"
মোবারক সাহেবের এখন শুধু মুক্তি চাই।

লোকটা একটা ছোট কাঁচের শিশি বের করল। শিশির মুখ খুলতেই ঘরঘর শব্দ হলো। যেন হাজারটা মশা একসঙ্গে ডাকছে। লোকটা শিশিটা মোবারক সাহেবের পায়ের কাছে ধরল।
মোবারক সাহেব দেখলেন, তার পায়ের নিচের ঘন কালো ছায়াটা ধীরে ধীরে তরল হয়ে যাচ্ছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে শিশির ভেতরে ঢুকে পড়ছে।
পুরোটা ঢুকতে পাঁচ মিনিট লাগল। লোকটা ছিপি এঁটে দিল। মোবারক সাহেবের হাতে পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিল।

মোবারক সাহেব রাস্তায় নামলেন। দুপুরবেলার গনগনে রোদ। তার পায়ের নিচে কিচ্ছু নেই। অদ্ভুত হালকা লাগছে। যেন মাধ্যাকর্ষণ কমে গেছে। তিনি প্রায় উড়তে উড়তে বাসায় ফিরলেন।
বিকেলে তিনি ছাদে গেলেন। দেখলেন, অন্য সবকিছুর ছায়া পড়েছে। পাশের বাড়ির আমগাছের ছায়া, ছাদের রেলিংয়ের ছায়া। শুধু তার ছায়া নেই। তিনি রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন একটা স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসের মতো।

রাতে ঘুমাতে গিয়ে টের পেলেন সমস্যাটা।
তিনি দুঃস্বপ্ন দেখলেন না ঠিক। কিন্তু তিনি কোনো স্বপ্নই দেখলেন না। গভীর, পাথরের মতো ঘুম হলো। সকালে উঠে মনে হলো, তিনি গত আট ঘণ্টা মারা গিয়েছিলেন।
সকালে নাস্তা করতে বসলেন। রুটি চিবোচ্ছেন, কিন্তু স্বাদ পাচ্ছেন না। কোনো কিছুরই গভীরতা টের পাচ্ছেন না। পৃথিবীটা কেমন যেন দ্বিমাত্রিক হয়ে গেছে।

তিনি বুঝলেন, ছায়া মানে শুধু আলোর অনুপস্থিতি নয়। ছায়া মানে গভীরতা। ছায়া মানে অস্তিত্বের প্রমাণ। যে বস্তুর ছায়া নেই, সেই বস্তুর অস্তিত্বও নড়বড়ে।

মোবারক সাহেব পাগলের মতো নিউ মার্কেটে দৌড়ালেন।
ফুটপাতের সেই লোকটা নেই। আজ বুধবার। মার্কেট বন্ধ।
মোবারক সাহেব মার্কেটের বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। কড়া রোদ। তার কোনো ছায়া পড়ছে না।
একটা রিকশা তার গা ঘেঁষে চলে গেল। রিকশাওয়ালা তাকে দেখল, কিন্তু ঠিক গ্রাহ্য করল না। যার ছায়া নেই, তাকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।

মোবারক সাহেব টের পেলেন, তিনি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। প্রথমে তার ছায়াটা গেল। এখন তিনি নিজে যেতে শুরু করেছেন। পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে তিনি নিজের অস্তিত্ব বিক্রি করে দিয়েছেন।

তিনি এখন নিউ মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাকে দেখা যায়। আবার ঠিক দেখাও যায় না। তিনি আছেন। আবার নেই।
Previous Post Next Post