আমার বুটের তলায় শুকনো পাতার গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার শব্দটা আজকাল সিম্ফনির মতো লাগে। চারপাশের এই ভ্যাপসা গন্ধ—যেখানে পচা কাঠ, ভেজা মাটি আর কোনো অদেখা ফুলের তীব্র সুবাস মিশে আছে—এটাই আমার পারফিউম। লোকে সেন্ট লাগায় অন্যকে আকর্ষণ করতে, আমি এই জঙ্গলের গন্ধ মাখি নিজেকে বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য।
ভালোবাসা? শব্দটা শুনলেই আমার পেটের ভেতর কেমন মোচড় দেয়, ঠিক যেমন ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স থাকা কেউ এক গ্লাস দুধ খেয়ে ফেললে হয়। অপ্রয়োজনীয়, হজম করা কঠিন, আর শেষ পর্যন্ত অস্বস্তিকর। আমার জীবনে ওসবের কোনো জায়গা নেই। আমার দরকার স্পেস, নিরেট, খাঁটি একাকিত্ব।
মানুষ একা থাকতে ভয় পায়, কারণ একা থাকা মানে নিজের মুখোমুখি বসা। আর সত্যি বলতে, বেশিরভাগ মানুষই নিজের সঙ্গ পছন্দ করার মতো ইন্টারেস্টিং না। তারা নিজেদের ভেতরের শূন্যতা ঢাকতে অন্য মানুষের গোলমাল খোঁজে। আমার কাছে এই জঙ্গলটাই যথেষ্ট। এখানে প্রতিটা গাছ, প্রতিটা পোকা—সবার নিজস্ব একটা গল্প আছে।
এই যে বাঁ দিকে যে মাকড়শাটা জাল বুনছে, এটা Argyroneta aquatica নয়, ওটা ইউরোপে থাকে। এটা একটা লোকাল ভ্যারাইটি, সম্ভবত এখনো ক্লাসিফাইড হয়নি। এর জালের জ্যামিতি দেখুন। নিখুঁত গোল্ডেন রেশিও। একটা মাকড়শা যা বোঝে, শহরের অর্ধেক আর্কিটেক্ট তা বোঝে না। ভালোবাসা এর চেয়ে নিখুঁত কিছু বানাতে পেরেছে? সন্দেহ।
আমি এখানে একটা বিশেষ অর্কিড খুঁজছি। Phalaenopsis amabilis—যেটাকে 'মথ অর্কিড' বলে, ওটা তো নার্সারিতেও পাওয়া যায়। আমি যার খোঁজে এসেছি, তার কোনো বাংলা নাম নেই। বোটানিক্যাল নামটাও বিতর্কিত। এটা শুধু অমাবস্যার পরের তৃতীয় রাতে ফোটে, আর এর রেণু অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। কেন? কারণ এটা সাধারণ মৌমাছিকে আকর্ষণ করে না; এটা এমন এক ধরনের নিশাচর পোকাকে টার্গে করে, যারা আল্ট্রাভায়োলেট আলো দেখতে পায় না, কিন্তু ফসফরাসের আভা চিনতে পারে।
এই দেখুন, পেয়ে গেছি।
গাছের ডালের খাঁজে, শ্যাওলার আড়ালে, একটা হালকা নীলাভ আভা। আমার গায়ে কাঁটা দিলো। এটা ভালোবাসা না, এটা অ্যাড্রেনালিন। একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করার তীব্র, বিশুদ্ধ আনন্দ।
আমি ক্যামেরা বের করি, ডেটা লগবুক রেডি করি। আমার এই সেটিংসে অন্য কোনো মানুষের অস্তিত্ব মানেই দূষণ। একজন মানুষ আসা মানেই তার আবেগ, তার আশা, তার চাহিদা—পুরো ইকোসিস্টেমটা নষ্ট করে দেবে।
লোকে বলে, "মানুষ সামাজিক জীব।" এটা একটা অর্ধসত্য। মানুষ সামাজিক জীব, কারণ একা বাঁচার মতো যথেষ্ট রিসোর্স বা মানসিক শক্তি তাদের নেই। আমার আছে।
আমার কাঁধের ব্যাগে একটা স্যাটেলাইট ফোন আছে, একটা সোলার চার্জার আছে, তিন সপ্তাহের ড্রাই ফুড আছে আর আছে 'দ্য মেডিটেশনস অফ মার্কাস অরেলিয়াস'-এর একটা পকেট এডিশন। আমার আর কী লাগে?
ভালোবাসা হলো একটা মিউচুয়াল প্যারাসাইটিজম, যেখানে দুজন মানুষ একে অপরের দুর্বলতাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকে। আমার কোনো দুর্বলতা নেই, তাই আমার কোনো হোস্টেরও প্রয়োজন নেই।
অর্কিডটার ছবি তুলতে তুলতে আমার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে ওঠে। এই জঙ্গলটা আমার। এই মুহূর্তটা আমার। এখানে কোনো ভাগাভাগি নেই, কোনো কম্প্রোমাইজ নেই।
একটু দূরে একটা শেয়াল ডেকে উঠলো। হয়তো ও ওর সঙ্গীকে ডাকছে। ডাকুক। আমার একমাত্র সঙ্গী হলো এই রাতের আকাশ, যার অসীম শূন্যতা আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে আমি একা, এবং এটাই সবচেয়ে স্বস্তির ব্যাপার।
