সোশ্যাল স্কোর




একটা ছেলে, বয়স বড়জোর বাইশ, রিকশা থেকে নামল। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মেটানোর সময় সে এমন একটা হাসি দিল, যেন এই রিকশাওয়ালা তার হারিয়ে যাওয়া আপন ভাই। পকেট থেকে রুমাল বের করে রিকশাওয়ালার কপালে ঘাম মুছে দিল। তারপর খুব বিনীত গলায় বলল, "চাচা, সাবধানে যাবেন। রোদের যা তেজ!"

আশেপাশে যারা ছিল, সবাই মুগ্ধ। কিন্তু আমি জানি, ছেলেটা আসলে একটা বড় মাপের অভিনেতা। ও এখন মনে মনে ক্যালকুলেটর চাপছে। রিকশাওয়ালার ঘাম মুছে দেওয়ায় তার ‘সোশ্যাল স্কোর’ অন্তত ১০ পয়েন্ট বাড়ার কথা। এই ১০ পয়েন্ট দিয়ে সে সন্ধ্যায় শান্তিনগরে কোনো এক ফ্যান্সি রেস্তোরাঁয় কোল্ড কফি খাবে।

টাকা এখন মিউজিয়ামের বস্তু। কাগজের নোট বা প্লাস্টিকের কার্ড, সব ইতিহাস। এখন চলে ‘সোশ্যাল ক্রেডিট’। আপনি কতটা ভালো মানুষ, সেটাই আপনার কারেন্সি।

ব্যাপারটা শুনতে ইউটোপিয়া বা স্বর্গরাজ্যের মতো লাগে, তাই না? কিন্তু এর ভেতরে একটা ভয়ানক প্যাঁচ আছে।

আমার ঘড়িতে এখন স্কোর দেখাচ্ছে ৪.৫। অবস্থা খুবই খারাপ। কাল রাতে মেজাজ খারাপ থাকায় নিজের বিড়ালটাকে ধমক দিয়েছিলাম। বসার ঘরের স্মার্ট সেন্সর সেটা ধরে ফেলেছে। সাথে সাথে ২ পয়েন্ট মাইনাস। বিড়ালকে ধমক দেওয়া ‘প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা’র ক্যাটাগরিতে পড়ে। ফলে আজ দুপুরে আমার লাঞ্চ জুটবে না। ৪.৫ দিয়ে বড়জোর একটা সিঙ্গারা আর এক কাপ রং চা হতে পারে।

আমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। হাতিরপুলের দিকে যাব। আমার এখন পয়েন্ট দরকার। প্রচুর পয়েন্ট।

রাস্তায় একটা কলার খোসা পড়ে আছে। আগে হলে মানুষ ওটা এড়িয়ে যেত। এখন দেখি তিনজন লোক ওটার দিকে দৌড়াচ্ছে। রীতিমতো অলিম্পিক স্প্রিন্ট। যে আগে ওটা ডাস্টবিনে ফেলবে, তার একাউন্টে ৫ পয়েন্ট জমা হবে। শেষমেশ এক মোটাসোটা ভদ্রলোক জিতে গেলেন। তিনি খোসাটা ডাস্টবিনে ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা পবিত্র হাসি দিলেন। আকাশে ড্রোন উড়ছে। ওটাই সব দেখছে। ভদ্রলোক জানেন, ড্রোন তার হাসিটা রেকর্ড করেছে।

ভেবে দেখুন, মানুষের মস্তিষ্ক কিন্তু ডিজাইন করা হয়েছিল সারভাইভাল বা টিকে থাকার জন্য, নৈতিকতার জন্য নয়। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, মস্তিষ্কের যে অংশটা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, সেটা এখন সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে কীভাবে ভালো সাজার অভিনয় করা যায়। আগে মানুষ ভালো কাজ করত মনের টানে। এখন করে পেটের দায়ে।

সামনে একটা ভিক্ষুক বসে আছে। না, ভুল বললাম। এখন আর ভিক্ষুক নেই। যাদের স্কোর শূন্যের নিচে, তারা ‘সোশ্যাল রিহ্যাব’ সেন্টারে থাকে। এই লোকটা আসলে ভিক্ষুক না, সে একজন ‘অপরচুনিটি প্রভাইডার’ বা সুযোগ প্রদানকারী। সিস্টেম এদের এখানে বসিয়ে রাখে যাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এদের সাহায্য করে পয়েন্ট কামাতে পারে।

লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম কিছু নেই। দেওয়াস মতো কিছু নেই, কিন্তু করার মতো আছে। আমি লোকটার পাশে বসে পড়লাম। তার কাঁধে হাত রাখলাম।

"চাচা, মন খারাপ?"

লোকটা অবাক হয়ে তাকাল। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া মাখানো গলায় কথা বলতে থাকলাম। আমার মাথায় তখন ঘুরছে, এই সহানুভূতি দেখানোর জন্য কত পয়েন্ট মিলবে? ইমোশনাল সাপোর্ট দেওয়ার রেট এখন বাজারে বেশ চড়া। অন্তত ১৫ পয়েন্ট তো পাওয়া উচিত।

লোকটা আমার অভিনয়ে গলে গেল। তার চোখে পানি। আমি টিস্যু এগিয়ে দিলাম।

হঠাৎ আমার স্মার্ট ওয়াচ ভাইব্রেট করে উঠল। নোটিফিকেশন এসেছে: "অভিনন্দন! একজন দুস্থ নাগরিককে মানসিকভাবে সহায়তা করায় আপনার একাউন্টে ২০ পয়েন্ট যোগ হয়েছে। আপনার বর্তমান ব্যালেন্স ২৪.৫।"

আমি মনে মনে হাসলাম। যাক, দুপুরের বিরিয়ানির ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

সমস্যা হলো, এই সমাজে এখন আর কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। আমার স্ত্রী যখন আমাকে বলে, "তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে," আমি ভাবি, ওর কি বিউটি পার্লারে যাওয়ার জন্য এক্সট্রা পয়েন্ট দরকার? ও কি আমাকে কমপ্লিমেন্ট দিয়ে নিজের ‘পারিবারিক সম্প্রীতি’ স্কোর বাড়াতে চাইছে?

বন্ধু যখন ফোন দিয়ে শরীরের খোঁজ নেয়, তখন বুঝি তার হয়তো মুভি দেখার জন্য কিছু ক্রেডিট কম পড়েছে।

আমরা সবাই এখন ফেরেশতা। কিন্তু প্লাস্টিকের ফেরেশতা। মনের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলছে লোভ আর স্বার্থপরতা, কিন্তু মুখে লেগে আছে প্রশান্ত হাসি। এই যে আমি এখন আপনাদের সাথে কথা বলছি, লেখাটা লিখছি, এটাও কিন্তু নিঃস্বার্থ নয়। আপনারা যদি এই লেখাটা পড়ে একটা ‘লাইক’ বা পজিটিভ রিঅ্যাকশন দেন, আমার লেখক স্কোর বাড়বে। সেই স্কোর দিয়ে আমি হয়তো আগামী মাসে মালদ্বীপ ট্যুরে যাব।

কি অদ্ভুত, তাই না?

একসময় মানুষ পাপ করতে ভয় পেত নরকের ভয়ে। এখন মানুষ খারাপ আচরণ করতে ভয় পায়, না খেয়ে মরার ভয়ে। ফলাফল একই, সবাই ভালো। পরিসংখ্যানের খাতায় ক্রাইম রেট শূন্য। ঝগড়াঝাঁটি নেই, গালিগালাজ নেই। বাসে কেউ কারো পায়ে পাড়া দিলে উল্টো সরি বলে।

কিন্তু এই যে এত এত ভালো মানুষ, এদের ভিড়ে আমি আজ পর্যন্ত একটাও ‘মানুষ’ খুঁজে পেলাম না। সবাই কেবল স্কোরবোর্ড নিয়ে হাঁটছে।

হঠাৎ দেখলাম একটা ছোট মেয়ে। বছর পাঁচেক বয়স। হাতে একটা আইসক্রিম। সে আইসক্রিমটা খাচ্ছে না, গলে গলে তার জামায় পড়ছে। মেয়েটা একমনে একটা পঙ্গু কুকুরছানার দিকে তাকিয়ে আছে। কুকুরটা নড়তে পারছে না।

মেয়েটা তার আইসক্রিমটা কুকুরটার মুখের সামনে ধরল। কুকুরটা চাটতে শুরু করল। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল।

আমি থমকে দাঁড়ালাম। মেয়েটার হাতে কোনো স্মার্ট ওয়াচ নেই। ও জানে না এই কাজের জন্য ও কত পয়েন্ট পাবে। ও জানে না এই আইসক্রিমটা নষ্ট করায় ওর মায়ের ‘প্যারেন্টিং স্কোর’ কমে যেতে পারে। ও কেবল আনন্দ পাওয়ার জন্য কাজটা করছে।

বুকের ভেতর কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগল। বহুদিন পর, বহু যুগ পর যেন সত্যিকারের একটা দৃশ্য দেখলাম। যেখানে কোনো গণিত নেই, কোনো এলগরিদম নেই, পয়েন্টের হিসাব নেই। কেবল নির্ভেজাল একটা টান।

আমি মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার ওয়াচ আবার ভাইব্রেট করছে। আমি ওটার দিকে তাকালাম না। হাত থেকে ঘড়িটা খুলে পকেটে রাখলাম।


Previous Post Next Post