অদৃশ্য সংকেত




গাছপালা। আপাতদৃষ্টিতে স্থির, নিশ্চুপ মনে হলেও তারা তো আসলে নিরন্তর কথা বলছে। নিজেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছে, প্রাণীদের সাথে বার্তা আদান-প্রদান করছে, মাটির নিচে তাদের শেকড়গুলো দিয়ে এক বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করছে। বিজ্ঞানীরা এখন প্রমাণ পেয়েছেন যে গাছেরা মাটির নিচে থাকা ছত্রাকের জালের মাধ্যমে একে অপরের সাথে পুষ্টি এবং তথ্য আদান-প্রদান করে। এই নেটওয়ার্ককে বলা হয় 'উড ওয়াইড ওয়েব' বা 'মাইকোরিজাল নেটওয়ার্ক'। যখন কোনো একটি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা আক্রমণের শিকার হয়, তখন সে এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংকেত পাঠায়, যাতে তার প্রতিবেশীরা সতর্ক হতে পারে এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। কী বিস্ময়কর!

আমরা যারা শহরে থাকি, কংক্রিটের জঙ্গলে বেড়ে উঠি, তারা হয়তো এই জগতের নীরব ভাষাটা ভুলে যেতে বসেছি। কিন্তু প্রকৃতি তার এই নীরব ভাষা দিয়েই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্পগুলো বলে চলেছে। যেমন, কোনো একটি জায়গায় যখন বড় আকারের ভূমিকম্প হয়, তার কয়েক মাস আগে থেকে সেখানকার ভূগর্ভস্থ জলস্তরে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। জলে রেডন গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়, জলের তাপমাত্রা বা রাসায়নিক গঠন পাল্টে যায়। প্রাণীরাও কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে, তাদের আচরণে পরিবর্তন আসে। বিজ্ঞানীরা এই বিষয়গুলোকে পর্যবেক্ষণ করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রকৃতি তো আমাদের সবকিছু আগেই জানিয়ে দেয়, কেবল আমাদের সেই সংকেতগুলো বোঝার মতো সংবেদনশীলতা তৈরি করতে হবে।

এই সংবেদনশীলতা তৈরি হয় যখন আমরা কৌতূহলকে জাগিয়ে রাখি, যখন নতুন কিছু শেখার আগ্রহটা জিইয়ে থাকে। আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন, কেন আমাদের আঙুলের ডগায় এই অদ্ভুত রেখাগুলো থাকে, যা ফিঙ্গারপ্রিন্ট নামে পরিচিত? এর পেছনের কারণটা সহজ হলেও বেশ কার্যকরী। এই রেখাগুলো আমাদের জিনিসপত্র ধরতে সাহায্য করে, ঘর্ষণ তৈরি করে যাতে আমাদের হাত থেকে জিনিস পিছলে না যায়। অনেকটা গাড়ির টায়ারের গ্রিপের মতো। আর এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট এতই অদ্বিতীয় যে পৃথিবীর বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের মধ্যে কারোর সাথে কারোর হুবহু মিল নেই। প্রতিটি মানুষের একটা নিজস্ব, অদ্বিতীয় নকশা। এই যে অসীম বৈচিত্র্য, প্রতিটা সৃষ্টিতে এক অকল্পনীয় স্বতন্ত্রতা—এটাই তো মহাবিশ্বের সবচেয়ে দারুণ রহস্য। ঠিক যেমন গ্যালাক্সির মেঘে ভাসমান অসংখ্য তারকারাজি, প্রতিটিই আলাদা, প্রতিটিই নিজস্ব আলোয় ভাস্বর। মনে হয়, মহাবিশ্বের এক বিশাল চিত্রকর যেন প্রতিটি সত্তাকে আলাদা করে এঁকেছেন, আর তাঁর তুলির প্রতিটি টানে মিশিয়ে দিয়েছেন এক অনন্য জাদুকরী ছোঁয়া। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো যখন বুঝতে পারি, তখন জীবন আরও বেশি অর্থপূর্ণ মনে হয়, আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

Previous Post Next Post