ডানা মেলার ইচ্ছে




ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে বাতাস মেখে। সেই গন্ধের সাথে মিশে আছে আম পাতার ভিজে সুবাস। রতন মিয়ার নাকের কাছে এসে যেন কেউ জোর করে শুঁকিয়ে দিচ্ছে। শহরের কোলাহল একটু শান্ত হয়েছে এই বৃষ্টিতে। ভ্যান-রিকশার হাঁকডাক আর মাইকের ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দ তেমন তীব্র লাগছে না। দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে, কেমন যেন নরম আর ভেজা ভেজা। কানে বাজছে না, বরং মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। রতন মিয়া প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে আলতো করে সিঁড়ির দিকে তাকালেন। কেউ আসছে না। তার স্ত্রী সাবিহা বেগম নিশ্চয়ই রান্নাঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এই বিকেলবেলায় ছাদে এসে দাঁড়িয়ে থাকাটা তার একটা পুরোনো অভ্যাস। কোনো কাজ না থাকলে তিনি ছাদের এই কোণটায় এসে দাঁড়ান। নিচে তাকালে পুরনো টিনের চালের ঘরগুলো দেখা যায়, তাদের পাশ দিয়ে চলে গেছে সরু গলি। ছেলেমেয়েরা মার্বেল খেলছে, নয়তো কাগজের নৌকা ভাসাচ্ছে জমাট পানিতে। হঠাৎই তার চোখ পড়ল অনেক দূরে, আকাশের অনেকটা উঁচুতে। একটা চিল। তবে সাধারণ কোনো চিল নয়। বিরাট ডানা মেলে ঘুরছে। এক মুহূর্তও ডানা না ঝাপটে যেন শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। এত সাবলীল তার উড়ে চলা! তার গতিতে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো দ্বিধা নেই। যেন সে জানে কোথায় যাবে, কেন যাবে। রতন মিয়া মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হালকা হয়ে এলো। তার মনে হলো, আহা, যদি এমন করে উড়ে বেড়ানো যেত! মানুষ জন্ম নেয়, বড় হয়, তারপর একটা গণ্ডির মধ্যে বন্দি হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। রোজকার কাজ, ঘরের চিন্তা, সামান্য কিছু টাকার জন্য ছোটাছুটি। অথচ এই চিলটা! ওর কোনো বাঁধন নেই। ওর কি কোনো টাকার চিন্তা আছে? ওর কি কালকের খাবারের চিন্তা আছে? নেই। শুধু আছে অনন্ত আকাশ আর মুক্ত বাতাস। জীবনের এই সহজ স্বাধীনতাটা মানুষ কেন হারায়? এই প্রশ্নটা তার মনে প্রায়ই আসে, কিন্তু উত্তর খুঁজে পান না। - - - চিলটা তার ডানার এক ঝলক আলোয় আকাশের সীমা ছাড়িয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। রতন মিয়া চোখ সরিয়ে নিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের গভীর থেকে। মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে আছে। চিলটার উড়ে যাওয়া দেখে তাঁর নিজের জীবনে অনেক অতৃপ্তির কথা মনে পড়ে গেল। এমন করে তো তিনিও উড়তে চেয়েছিলেন একসময়। তারুণ্যে যখন পাখা মেলতে শুরু করেছিলেন, তখন তো আর জানতেন না যে এই জীবনটা একটা অদৃশ্য সুতার টানে বাঁধা থাকবে। সুতাটা কার হাতে? সমাজের? পরিবারের? নাকি নিজেরই বানানো কিছু নিয়মের জালে? উত্তরটা আজও তিনি খুঁজে পাননি। ছাদের ভেতরের দিকে বেশ খানিকটা শুকনো জায়গা। সেখানেই বিকেলে রতন মিয়া ছোট ছোট টবে কিছু ফুল গাছ লাগিয়েছেন। ডাঁটা নুইয়ে সদ্য ফোটা গোলাপের কুঁড়িগুলো বৃষ্টির পানিতে আরও সতেজ দেখাচ্ছে। একটা সাদা জবা ফুলে তখনও বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা আটকে আছে। মুক্তোর মতো চিকচিক করছে। রতন মিয়া নিচু হয়ে ফুলটার খুব কাছে গেলেন। কেমন একটা হালকা সুগন্ধ। ফুলের পাপড়িগুলো এতটাই নরম যে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তিনি ছোঁন না। শুধু তাকিয়েই থাকেন। যেন ছুঁয়ে দিলে তাদের সতেজতা নষ্ট হয়ে যাবে। তার মনে পড়ল, ছোটবেলায় যখন গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, তখন উঠোনের পাশে অনেক জবা গাছ ছিল। মা বলতেন, "ফুল ছেঁড়ো না রতন। ওদেরও জীবন আছে। গাছে থাকতে দাও।" সেই কথাটা তার মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে। আজও তিনি ফুল ছিঁড়তে পারেন না। অথচ আজকালকার বাচ্চারা খেলার ছলে টুপটাপ করে ফুল ছিঁড়ে ফেলে, আর তাদের বাবা-মায়েরা দেখেও না দেখার ভান করে। এই ছোট ছোট মূল্যবোধগুলোই যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আকাশটা আরও একটু ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। দিনের আলো শেষ হওয়ার আগে শেষবারের মতো সব রঙ ছড়িয়ে দিতে চাইছে। পশ্চিম দিকে মেঘগুলো এখন গোলাপি আর কমলা রঙ মেখেছে। যেন কোনো শিল্পী সাদা ক্যানভাসে তুলির শেষ আঁচড় দিচ্ছে। রতন মিয়া রেলিং থেকে শরীরটা সরিয়ে নিলেন। সন্ধ্যা নামার আগে আলো কমে আসার এই সময়টা তার কাছে একটু বিষণ্ণ লাগে। মনে হয়, দিনটা যেন বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আজও তেমন কিছু করা হলো না, যা মনে রাখার মতো। অথচ এমন কত দিন চলে গেল তার জীবনের খাতা থেকে। নিছকই সাদামাটা কিছু ঘটনা, কিছু হিসাব-নিকাশ। হঠাৎই নিচতলা থেকে সাবিহা বেগমের গলা শোনা গেল, "এতোক্ষণ ছাদেই আছো নাকি? সন্ধ্যা হয়ে এল যে! আর কতক্ষণ লাগবে তোমার?" রতন মিয়া হালকা হাসলেন। এই তো জীবন! এক পলকের মুগ্ধতা, আর পরের পলকেই দায়িত্বের অদৃশ্য ডাক।

Previous Post Next Post