ছোটবেলায় আমার একটা অভ্যাস ছিল। এখনো আছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, অথবা র্যান্ডম কোনো এক প্লেসে আমি মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়াতাম, চোখ বন্ধ করতাম, আর নিজেকে প্রশ্ন করতাম: "এই মুহূর্তে আমি এখানে কেন? আমি কী বাস্তবিকই এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছি, নাকি কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে?"
আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এই প্রশ্নটি একবার না একবার উঁকি দেয়। আমরা কি স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী, নাকি আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পূর্বনির্ধারিত? আমাদের সিদ্ধান্তগুলো কি আসলেই আমাদের নিজস্ব, নাকি আমরা অন্যদের দেখে প্রভাবিত হই? আর যদি তাই হয়, তবে এই প্রভাবের চক্র কোথায় শেষ হয়?
আমাদের ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে, তাকদীর (নিয়তি) একটি মৌলিক বিশ্বাস। আল্লাহ্ সবকিছু জানেন এবং সবকিছু লিখে রেখেছেন। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে আমরা নিছক পুতুল, যারা নিয়তির সুতায় নাচছি?
কোরআন শরীফ বলে: "নিশ্চয় আল্লাহ্ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।" (সূরা রা'দ: ১১)
এটা যেন বলছে: হ্যাঁ, নিয়তি আছে, কিন্তু সেই নিয়তির মধ্যেই আমাদের পছন্দগুলোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একটা উদাহরণ দিই:
আকাশে তারাগুলো একটা নির্দিষ্ট পথে চলে, তাদের কোনো স্বাধীন ইচ্ছা নেই। কিন্তু আমরা মানুষ - আমরা সেই তারার আলো দেখতে পাই, তার অবস্থান থেকে দিক নির্ণয় করতে পারি, কিন্তু আমরা তারাদের মতো নিয়মের বন্দী নই।
আমি যখন কলেজে ছিলাম, একটা সময় আমি সকালে উঠে নামাজ পড়তাম না। কিন্তু আমার রুমমেট নিয়মিত ফজরের নামাজ পড়ত। কয়েক সপ্তাহ পর আমিও তার সাথে উঠতে শুরু করলাম। আমি কি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম? নিঃসন্দেহে।
আমাদের জীবন একটি অদৃশ্য প্রভাবের নেটওয়ার্কে আবদ্ধ। আমার রুমমেট প্রভাবিত হয়েছিল তার বাবার দ্বারা, তার বাবা হয়তো প্রভাবিত হয়েছিলেন তাদের গ্রামের ইমাম সাহেবের দ্বারা, আর ইমাম সাহেব প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর শিক্ষকের দ্বারা... এভাবে চলতে থাকে।
এটা একটা চেইন রিয়েকশন, যা হাজার বছর ধরে চলে আসছে। কিন্তু এই চেইনটা কি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
একবার একটা পাতা একটা পুকুরে পড়ল। সেটা পুকুরে ছোট ছোট ঢেউ তৈরি করল। সেই ঢেউ আরেকটা পাতাকে নাড়া দিল, যেটা একটা ব্যাঙের নজরে পড়ল। ব্যাঙটা লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল, একটা পাখি ওড়ার সময় সেটা দেখল, আর...
বুঝতেই পারছ, এই চেইন রিয়েকশন অসীম। বিজ্ঞানীরা একে "বাটারফ্লাই ইফেক্ট" বলেন – একটা প্রজাপতির ডানার ঝাপটা সারা পৃথিবীর আবহাওয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।
তাহলে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা কোথায়? এটা কি শুধুই একটা ভ্রম?
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা আর নিয়তি একই মুদ্রার দুই পিঠ। আল্লাহ্ আমাদের বিকল্প বেছে নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন, এটাই আমাদের পরীক্ষা।
ইমাম আল-গাজালী বলতেন, আমাদের প্রতিটি কাজ "কাসব" বা অর্জন – এটা আমাদের নিজস্ব পছন্দ, কিন্তু আল্লাহ্ই এই পছন্দের ফলাফল সৃষ্টি করেন। একটা সহজ উদাহরণ:
আমি পানি পান করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এটা আমার ইচ্ছা। কিন্তু পানি আমার তৃষ্ণা মেটাবে কি না, তা আমার হাতে নয় – এটা আল্লাহ্র ইচ্ছা।
প্রভাবের এই চক্র কোথায় শেষ হয়? আমার মতে, এটা শেষ হয় না – এটা একটি বৃত্ত।
ইতিহাসের প্রথম মানুষ (আদম আ.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, আমরা সবাই একে অপরকে প্রভাবিত করি। আর এই বৃত্তের কেন্দ্রে আছেন আল্লাহ্ তা'আলা, যিনি সবকিছুর আদি ও অন্ত।
জীবন একটা সমুদ্রযাত্রার মতো। আল্লাহ্ আমাদেরকে একটা নৌকা দিয়েছেন (আমাদের দেহ ও মন), এবং একটা পথনির্দেশক (কোরআন ও সুন্নাহ)। বাতাস কোন দিকে বইবে (পরিস্থিতি), তা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু আমরা পাল কোন দিকে ঘুরাব (আমাদের সিদ্ধান্ত), সেটা আমাদের হাতে।
মাঝে মাঝে আমরা অন্য নৌকাগুলো দেখে দিক পরিবর্তন করি (প্রভাবিত হই), আবার কখনো আমাদের নিজস্ব পথে চলি।
ইমাম শাফেয়ী (রহ.) কে যখন কদর (নিয়তি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন: "এটা এমন এক সমুদ্র যেখানে প্রবেশ করো না।"
তবে এই রহস্য নিয়ে চিন্তা করা, এর প্রতি শ্রদ্ধা রাখা, এবং আমাদের পছন্দগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করা – এটাই হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
সব শেষে, যেমন কবি ইকবাল বলেছিলেন:
"খুদি কো কর বুলন্দ ইতনা, কি হর তকদীর সে পহলে, খুদা বন্দে সে খুদ পুছে, বতা তেরি রজা ক্যা হ্যায়?" (তোমার আত্ম-সচেতনতাকে এতটাই উন্নত করো যে, প্রতিটি নিয়তি লিখার আগে, আল্লাহ্ নিজেই তোমাকে জিজ্ঞেস করেন: "বলো, তোমার ইচ্ছা কী?")
