চেতনা অন্বেষণ


আমাদের চারপাশে কোটি কোটি প্রাণী, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত সবকিছুই অস্তিত্বশীল। কিন্তু আমরা মানুষ "জানি" যে আমরা আছি, এক্সিস্ট করি। আমাদের মধ্যে রয়েছে একটি অন্তর্নিহিত সত্তা যা সবকিছু প্রত্যক্ষ করে, অনুভব করে, চিন্তা করে।

আল্লাহ পাক কুরআনে বলেছেন: "আমি মানুষকে আমার রূহ থেকে ফুঁকে দিয়েছি।" এই রূহ - আমাদের আত্মা - যা আমাদের চেতনার মূল উৎস। এটা আমাদের মধ্যে সেই দিব্য স্পর্শ যা আমাদেরকে কেবল জীবিত প্রাণী নয়, বরং সচেতন প্রাণী বানিয়েছে।

আমি প্রায়ই ভাবি, আমার মস্তিষ্ক যখন শুধু নিউরনের সমষ্টি, তখন সেখান থেকে এই "আমি"-বোধ কীভাবে উদ্ভূত হয়? বিজ্ঞান আমাদের বলে, আমাদের মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো থেকেই চেতনা জন্ম নেয়। কিন্তু একটি কম্পিউটারও বিদ্যুৎ সিগন্যাল ব্যবহার করে, কিন্তু সে কি জানে যে সে আছে?

আমার মনে হয় চেতনা হল আল্লাহর একটি বিশেষ উপহার। শরীরের মধ্যে আত্মার প্রকাশ। এটি ঠিক যেমন আলো একটি প্রিজমের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন রঙে বিচ্ছুরিত হয়, তেমনি আমাদের চেতনাও বিভিন্ন অনুভূতি, চিন্তা, আবেগ হিসেবে প্রকাশ পায়।

আকাশে একটি পাখি উড়তে দেখলাম। হঠাৎ ভাবলাম: এই পাখিটা কি জানে যে সে উড়ছে? সে কি আমার মতো অনুভব করে? নাকি শুধু প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়ে একটি যান্ত্রিক জীবন যাপন করছে?

মসজিদের ইমাম সাহেব একবার বলেছিলেন, "আল্লাহ সব প্রাণীকে চেতনা দিয়েছেন, কিন্তু মানুষকে দিয়েছেন আত্ম-চেতনা।" এই আত্ম-চেতনাই আমাদেরকে নিজেদের নিয়ে চিন্তা করার, প্রশ্ন করার, আমাদের অস্তিত্বের অর্থ খোঁজার ক্ষমতা দেয়।

যখন আমি ঘুমাই, আমার চেতনা কোথায় যায়? "আল্লাহ মৃত্যুর সময় আত্মাকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন এবং যারা মৃত্যুবরণ করেনি তাদের ঘুমের সময় আংশিকভাবে গ্রহণ করেন। (যুমারঃ৪২)" এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে ঘুম হল মৃত্যুর ছোট ভাই, যেখানে আমাদের চেতনা আংশিকভাবে আমাদের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।

আমাদের চেতনা শুধু জাগ্রত অবস্থায় নয়, স্বপ্নেও সক্রিয় থাকে। স্বপ্নে আমরা এমন জগতে বিচরণ করি যা বাস্তব নয়, কিন্তু আমাদের চেতনা সেটাকে বাস্তব হিসেবেই অনুভব করে। আল্লাহ পাক কত অসাধারণভাবে আমাদের মনকে সৃষ্টি করেছেন!

বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের চেতনার জন্য প্রধানত আমাদের সিরেব্রাল কর্টেক্স দায়ী। কিন্তু আমি ভাবি, যদি শুধু আমার মস্তিষ্কই আমার চেতনার উৎস হত, তাহলে আমি কখনো আমার মস্তিষ্ক নিয়ে ভাবতে পারতাম না। যে জিনিস নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারে, সেটা অবশ্যই সেই জিনিসের চেয়ে বেশি কিছু।

হজরত আলী (রা.) একবার বলেছিলেন: "তুমি ভাবো যে তুমি একটি ছোট শরীর, অথচ তোমার মধ্যে রয়েছে এক বিশাল জগৎ।" আমাদের চেতনা আমাদের দেহের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। আমরা চিন্তায় অতীতে ফিরে যেতে পারি, ভবিষ্যতের কল্পনা করতে পারি। আমরা অন্য মানুষের অবস্থান থেকে বিষয়গুলো ভাবতে পারি। এমনকি, আমরা এমন জিনিস কল্পনা করতে পারি যা বাস্তবে অস্তিত্বহীন।

আমাদের চেতনার এই অসীম প্রসারণশীলতা আমাকে আল্লাহর মহত্ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কুরআনে আল্লাহ বলেন: "আমি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পর্বতমালার প্রতি আমানত পেশ করলাম, কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং এর থেকে ভীত হল। অবশেষে মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয়ই সে ছিল অত্যাচারী, অজ্ঞ।" এই আয়াতে উল্লিখিত আমানত হয়তো আমাদের চেতনা বা সচেতন ইচ্ছাশক্তি, যা আমাদেরকে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে আলাদা করে। আল্লাহু আলাম। 

একদিন আমি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও একটি জটিল সমস্যা বুঝতে পারছিলাম না। অথচ অন্য সময় এটা সহজ মনে হতো। হঠাৎ, একটি মুহূর্তে, সমাধানটি আমার মনে আলোর মতো ঝলসে উঠল। কেন এমন হয়? কীভাবে আমাদের চেতনা কখনো ধীরে ধীরে, আবার কখনো হঠাৎ করে সমাধান খুঁজে পায়?

আমি মনে করি, আমাদের চেতনা একটি আয়নার মতো। যেমন আয়না নিজে আলো উৎপন্ন করে না, বরং আলোকে প্রতিফলিত করে, তেমনি আমাদের চেতনাও আল্লাহর নূরকে প্রতিফলিত করে। আমাদের চেতনা যত পরিষ্কার হয়, তত বেশি সেই দিব্য আলো প্রতিফলিত হয়।

আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় আমাদের বাইরের জগতের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। কিন্তু শুধু ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে আমরা চেতনাকে ব্যাখ্যা করতে পারি না। আমরা কল্পনা করতে পারি এমন রঙ যা কখনো দেখিনি, এমন সুর যা কখনো শুনিনি।

সুফী সাধকরা বলেন, মানুষের চেতনা হল আল্লাহর একটি প্রতিফলন, যেমন জলের পৃষ্ঠে চাঁদের প্রতিবিম্ব। যখন জল তরঙ্গায়িত হয়, প্রতিবিম্ব বিকৃত হয়, কিন্তু আসল চাঁদটি অপরিবর্তিত থাকে। তেমনি, আমাদের চেতনাও যখন দুঃখ-কষ্ট, রাগ-অভিমানে বিক্ষুব্ধ হয়, তখন আমরা আমাদের প্রকৃত সত্তা থেকে বিচ্যুত হই।

আমাদের চেতনার সবচেয়ে অদ্ভুত দিক হল এর একাত্মতা। আমি একসাথে দেখি, শুনি, অনুভব করি, চিন্তা করি, স্মরণ করি - কিন্তু এগুলো সবই একটি একক অভিজ্ঞতার অংশ। আমার চেতনা বিভক্ত নয়, একীভূত।

এখন প্রশ্ন হল: যদি আমাদের চেতনা এতটাই অসাধারণ ও জটিল, তাহলে কি এটা নিছক একটা জৈবিক প্রক্রিয়ার ফলাফল? নাকি এর পেছনে কোনো দিব্য উদ্দেশ্য আছে?

ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেছেন, "আত্মা হল আল্লাহর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক সৃষ্টি। এটি না শরীর, না গুণ, না অবস্থা - এটি অন্য কিছু।" আমার কাছে মনে হয়, আমাদের চেতনা হল আমাদের ভিতরে আল্লাহর একটি স্বাক্ষর, যা আমাদেরকে তাঁর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

যখন আমি নামাজ পড়ি, এবং "আল্লাহু আকবর" বলে তাকবীর বাঁধি, তখন আমার চেতনা দুনিয়ার সমস্ত বিষয় থেকে সরে আসে এবং একমাত্র আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করে। এই মুহূর্তগুলোতে আমি অনুভব করি আমার চেতনার সবচেয়ে বিশুদ্ধ অবস্থা।

আমার বিশ্বাস, আমাদের চেতনার প্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে বোঝার জন্য আমাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করতে হবে। কারণ আমরা কেবল ভৌতিক সত্তা নই, আমরা আধ্যাত্মিক সত্তাও বটে।

আমাদের চেতনা আমাদেরকে দুনিয়ার সব প্রাণীর মধ্যে অনন্য করেছে। এটি আমাদের দিয়েছে বিবেক, নৈতিকতা, সৌন্দর্যবোধ, আধ্যাত্মিকতা। আমাদের এই চেতনা দিয়ে আমরা আল্লাহকে চিনতে পারি, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তাঁর হাতের কারুকার্য দেখতে পারি।

চেতনার প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা কতটুকু? আমরা এখনো আমাদের চেতনার পূর্ণ রহস্য উদঘাটন করতে পারিনি। যত বেশি আমরা জানি, তত বেশি বুঝতে পারি যে আমরা কত কম জানি। এবং এটাই হয়তো চেতনার সবচেয়ে সুন্দর দিক - এর অনন্ত রহস্যময়তা, যা আমাদেরকে সর্বদা আরো জানার, আরো বোঝার, আরো অনুভব করার আহ্বান জানায়।


Previous Post Next Post