মানুষ কি কখনো চিন্তাশূন্য হতে পারে?


তুমি-আমি এই শহুরে জীবনের চাপে দিনে হাজারো চিন্তা করি। টাকা, সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, মৃত্যু, ভবিষ্যৎ। সবকিছুই একটা মানসিক ট্রাফিক জ্যামের মতো। কিন্তু, যদি এমন হয়- একদিন, কোনো একটা সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, আমার মাথায় কোনো চিন্তা নেই? তখন আমি কি সত্যিই “আমি” থাকবো?


বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, ব্রেইন সবসময় ব্যস্ত। এমনকি যখন আমরা কিছু ভাবছি না, তখনও ব্রেইনের একেকটা কোণ ব্যাকগ্রাউন্ডে চিন্তার ড্রাফট বানিয়ে রাখছে। আমাদের অবচেতন মনে ভবিষ্যতের ভয়, অতীতের খোঁচা, কিংবা সম্পর্কের বাকি গল্পগুলো পাথরের মতো পড়ে থাকে। অর্থাৎ, জাগতিক মানে, আমরা কখনো চিন্তাশূন্য হই না। তবু মানুষ ধ্যান করে। চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। সেইখানে কি অন্যরকম কিছু ঘটে?


ধ্যানে, তুমি শুধু থাকো।

চিন্তা আসবেই। কিন্তু গভীর ধ্যানে একটা মুহূর্ত আসে, যখন তুমি চিন্তাগুলোর স্রোতে আর ভেসে যাও না। তুমি তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখো। যেমন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কেউ শুধু স্রোত দেখে যায়। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কোনো ধরার চেষ্টা নেই। শুধু দেখা। কিন্তু সে নদীতে ঝাপ দিচ্ছেনা।


এই দেখার মধ্যেই আছে চিন্তাশূন্যতার আস্বাদ। সেইটা কোনো জোর করে তৈরি করা অবস্থা না- বরং গভীর থাকা, নিঃশব্দ সচেতনতা।


চিন্তাহীনতা মানে শূন্যতা নয়, বরং পূর্ণতা।

অনেকেই ভাবে, চিন্তা না থাকলে কিছুই থাকবে না। কিন্তু গভীর চেতনাময়তায় তুমি টের পাবে। যখন চিন্তা থামে, তখন কেবল শূন্যতা আসে না, বরং এক নির্বাক পূর্ণতা এসে বসে।

একটা অনুভূতি যে তুমি আছো। ব্যাস। না কোনো ব্যাখ্যা, না কোনো পরিচয়। না কোনো লক্ষ্য, না কোনো ভয়।

সেই নিস্তব্ধতা নিজেই যেন প্রার্থনা। সেইখানে "তুমি" নেই, "তোমার চিন্তা"ও নেই। শুধু একখানা অস্তিত্বের জ্যোৎস্না নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে ভিতরের আকাশজুড়ে।


সুফিরা বলেন, “যে যত গভীরে গেছে, সে তত কম বলেছে।” সেই গভীরতা, যেখানে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে মন থেমে যায়। যেখানে শব্দ নেই, চিন্তা নেই, ইচ্ছেও নেই। শুধু এক অদ্ভুত, অবর্ণনীয় থাকা। একধরনের বিলীনতা।

এই চিন্তাশূন্যতা ভয়ঙ্কর নয়। এটা মৃত্যু না, বরং নতুন জন্ম। নিজেকে চিন্তা দিয়ে গড়ার চেষ্টা না করে নিজের ‘ছিলাম-আছি-থাকবো’-কে নিঃশব্দে আলিঙ্গন করা।


এই লেখার উদ্দেশ্য ছিল প্রশ্নটা বাঁচিয়ে রাখা। যদি কখনো গভীর রাতে হঠাৎ তোমার মনে হয়, “আমি কি এখন একটুও চিন্তা করছি না?” তখন তুমি ভয় পেও না। কারণ হয়তো ঠিক তখনই, তুমি একটা দরজা পার হয়ে গেছো।

চিন্তার বাইরে যে নির্জনতার দেশ, তার পথচিহ্ন হয়তো সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়।

Previous Post Next Post