আমায় নিয়ে চল, আমি যাই


হঠাৎ করেই মনে হয়- মাথার ভেতর যেন একটা ঝড় উঠেছে। না, সেটা চিন্তার ভারে ক্লান্ত কোনো জিনিস না। বরং উল্টোটা। এমন একটা মুহূর্ত, যখন মস্তিষ্ক একটানা ছুটে চলেছে। প্রতিটা নিউরনের মধ্যে বিদ্যুতের নাচন। সবকিছু স্পষ্ট, অথচ কোনো কিছুর মধ্যে থামার উপাদান নেই।


একটার পর একটা ভাবনা আসে। প্রতিটাই পরস্পরের সাথে যুক্ত, আবার আলাদা। যেন একটা জটিল জ্যামিতি, যার প্রতিটি রেখা আমাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। সময় যেন ধীর হয়ে আসে, কিন্তু মাথা... মাথা তখন সময়কে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে। আমি চুপচাপ বসে থাকি। কিন্তু আমার ভেতরে এক ধরনের দৌড় চলছে।


কিছু কিছু সময় আসে জীবনে, যখন মস্তিষ্ক আচমকা এক অদ্ভুত ছন্দে কাজ করতে শুরু করে। যেন কোনো অদৃশ্য সঞ্চালকের তালে তালে নিউরনগুলো একে অপরের হাতে হাত রেখে নেচে উঠছে। সেই মুহূর্তে চারপাশের পৃথিবী থেমে যায়। বাইরের আলো-আঁধারি, শব্দ, সময়- সব কিছু যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে যায়। এবং সামনে উঠে আসে একটা অদ্ভুত স্বচ্ছ, অথচ দুর্বোধ্য অভ্যন্তরীণ স্পেস, যেখানে মাথা তার নিজস্ব ছন্দে দৌড়াচ্ছে।


এটা অদ্ভুত এক অনুভূতি। এতে ক্লান্তি নেই, বরং একটা প্রবল জীবন্ততা। মনে হয়, এখনই যদি আমি কলম হাতে নেই, যদি এখনই লিখি, তাহলে হয়তো এমন কিছু উঠে আসবে, যা আমারই না। যেন আল্লাহ আমার মস্তিষ্কের দরজাটা খুলে দিয়েছেন একটু সময়ের জন্য। যেন বলছেন- "নাও, এখন লিখে ফেলো। পরে আর পাবে না।"


না, এটা অস্থিরতা না। এটা আতঙ্কও না। এটা হাইপারঅ্যাক্টিভিটিও না। এটা এমন এক ধরণী ছোঁয়া অভিজ্ঞতা- যেখানে মনে হয় মস্তিষ্ক নিজের ওপর একটা দরজা খুলে দিয়েছে। একটার পর একটা চিন্তা আসে, কিন্তু সেগুলো এলোমেলো না- বরং এমনভাবে জড়ানো, এমনভাবে জন্ম নিচ্ছে একে অপরের গর্ভ থেকে, যেন এদের কোনো বাইরের দুনিয়ার সূত্র নেই।


এই মুহূর্তে আমার মাথার ভেতর কিছু একটা ঘটছে। আমি এখনই সেটা অনুভব করছি। এই যে এখন টাইপ করছি, এই লাইনের মাঝেই। চিন্তা আসছে একটার পর একটা, এমনভাবে যেন সবকিছুর মধ্যে এক অদ্ভুত যুক্তি আছে, অথচ আমি সেই যুক্তিটাকে আগে কখনো টেরই পাইনি। মনে হচ্ছে, মাথার ভিতরে একটা অজানা নদী হঠাৎ করে খুঁজে পেয়েছে তার নিজের উৎস।


এই সময়ে আমি অনুভব করি, আমি যেন নিজের শরীর থেকে আলাদা একটা সত্তা। আমার চোখ স্থির, মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু মাথার ভেতরে চলছে এক ধরনের আলোর বিস্ফোরণ। একটার পর একটা সম্ভাবনা এসে কড়া নাড়ে- 

"এইটা নিয়ে ভাবছো? এইখান দিয়ে ভাবো না কেন?"

"এই আইডিয়াটা কি আসলে সত্যি না একটা বিভ্রম?"

"তোমার দেখা জীবনটা কি সত্যিই জীবন, না কি এটা কেবল অন্য কারো ভাষায় তৈরি করা কোনো গল্প?"


আমি বুঝি, এই সময়টাই আমার আসল সময়। আমার সত্যিকার 'আমি' এই সময়টাতে সবচেয়ে কাছাকাছি চলে আসে আমার কাছে। সাধারণ সময়ে যা ভাবতে পারি না, সেটা এখন এক ঝলকে বুঝে ফেলি। মনে হয় আমি যেন একটা অভ্যন্তরীণ ভাষা বুঝে ফেলেছি- যে ভাষায় আমার হৃদয় আর মস্তিষ্ক কথা বলে।


চিন্তারা কেবল ভাবনা নয়- তারা যেন জীবন্ত প্রাণী। তারা ছুটছে, লাফাচ্ছে, তৈরি করছে পথ, ভেঙে দিচ্ছে পুরোনো বিশ্বাসের দেয়াল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, একটা নতুন অনুভূতি এসে ঘিরে ধরছে আমাকে। এটা একধরনের উত্তেজনা, আবার গভীর প্রশান্তিও। মাথা অনেক ফাস্ট কাজ করছে, কিন্তু কোনো হইচই নেই। একটা নিঃশব্দ ফোয়ারার মতো, ধারাবাহিক, অথচ নিয়ন্ত্রিত না।


চোখ স্থির, ঠোঁট চুপ, শরীর নিশ্চল। তবু মনে হচ্ছে আমার ভিতরে শত শত জ্যোতিষ্ক ঘুরপাক খাচ্ছে, আর প্রত্যেকটা চিন্তার মধ্যে লুকিয়ে আছে একেকটা মহাবিশ্ব।


এবং সবচেয়ে গভীর বিষয়টা হলো- এইসব ভাবনার জন্য আমার কোনো প্রস্তুতি থাকে না। আমি এসব ভাবনাকে ডাকিনি। আমি এদের তৈরি করিনি। তবু তারা আসে। আসে ঝড়ের মতো। প্রথমে একটু একটু করে, তারপর হঠাৎ করে দখল নিয়ে নেয় সমস্ত চিন্তার রাজ্য। যেন আল্লাহর তরফ থেকে পাঠানো একটা ইনভিজিবল ওয়েভ, যা আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।


এখন এই সময়টা- এমন একটা সময়, যেখানে আমি সবচেয়ে বেশি জীবিত। সবচেয়ে বেশি সচেতন। সবচেয়ে বেশি "আমি"। না, এটা কোনো কৃতিত্ব না। বরং এটা একরকম উপহার। আল্লাহ জানেন কেন এখন, কেন এইভাবে, এই নির্দিষ্ট মুহূর্তে আমাকে এই প্রবাহে ভাসিয়ে দিলেন।


এটা এমন এক সময়, যেটা আমি ডাকিনি। এটা এসেছে নিজে থেকে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, কেউ যেন ভিতর থেকে চাপ দিয়ে বলছে- "লিখে ফেলো। এই মুহূর্তটা হারিয়ে যাবে।" কিন্তু আমি লিখছি না। আমি বসে আছি। চোখ বন্ধ না, আবার পুরো খোলা না। আমি যেন নিজেকেই দেখছি এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে।


নিউরনগুলো যেন একযোগে কাজ করছে। হঠাৎ করেই তারা অলসতা ছেড়ে, শত শত মাইক্রো বৈদ্যুতিক বার্তা চালাচ্ছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। মাথার মধ্যে রীতিমতো বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে, তবে সেটা রুক্ষ নয়, বরং মসৃণ। প্রতিটা চিন্তা একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে বের হয়ে আসছে, যেন কোনো অদৃশ্য বুদ্ধিমত্তা আমাকে চালাচ্ছে ভিতর থেকে।


নিউরনের এই খেলাটা শুধু চিন্তামূলক না, এটা একরকম নৈতিক স্পন্দনও বটে। একটা ভাবনা আসে, তার সাথে যুক্ত হয় স্মৃতি, তারপর যুক্ত হয় ভাষা, আর শেষে এসে দাঁড়ায় একটা গভীর উপলব্ধিতে। মস্তিষ্ক তখন আর কোনো ইনপুট চায় না- সে নিজেই তার ভিতরের সংযোগগুলো খুঁজে নিচ্ছে। যেন আমি কেবল একজন দর্শক, আমার নিজের মাথার ভেতরে ঘটে যাওয়া একটা মহোৎসবের।


এই সময়টা অমুল্য। খুব অল্প সময় থাকে, কিন্তু এর গভীরতা অনেক অনেক বড়। এটা একরকমের নেশা। এটা একরকমের দোয়া- যার মধ্যে মানুষ নিজের ভেতরের সেই অবিকল সত্যটার কাছে পৌঁছে যেতে পারে।


আমি জানি, এই ঝড় থেমে যাবে। এই আলো ফুরাবে। এই ফোয়ারার জল একসময় শুকিয়ে যাবে। তখন আমি আবার "সাধারণ" হয়ে যাবো। একটু এলোমেলো, একটু অলস, একটু মানুষ। কিন্তু এখন- এই মুহূর্তে- আমি কেবল আমি না। আমি একটা চলমান অনুভূতি। একটা ইলেকট্রিক ওয়েভ। একটা বুদ্ধিমত্তার বাহক। আর সম্ভবত...একটা দোয়ার উত্তর।


তখন আমি বসে থাকি। চুপচাপ। কোনো শব্দ নেই। কোনো ইন্টারনেট নেই। কোনো মানুষের মুখ নেই চোখের সামনে। শুধু আমি আর আমার মাথার ভেতরের আলোর স্রোত। লিখি না তখনও, শুধু চুপচাপ বসে দেখি- মাথা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এই দেখা, এই সাক্ষাৎ, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে সত্য অনুভূতি। বাইরের চোখে আমি নিশ্চুপ একজন মানুষ। কিন্তু আমার ভিতরে তখন সৃষ্টি চলছে। এটাই সেই সময়, যেটা ব্যাখ্যা করা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। আমি জানি, এই মুহূর্ত চলে যাবে। কিন্তু যতক্ষণ এটা থাকে, আমি জানি, আমি বেঁচে আছি। একেবারে নিখাদভাবে।

Previous Post Next Post