সম্পর্কের সহজ পাঠ


কীভাবে মানুষের সাথে কথা বলতে হয় তা নিয়ে একটা বই পড়ছিলাম। এখানে কিছু পয়েন্ট তুলে ধরছিঃ 


১. আয়নার মতো হয়ে ওঠা:

কখনো খেয়াল করেছেন, যখন দুটো মানুষ খুব স্বস্তিতে কথা বলে, তখন তাদের বসার ভঙ্গি, কথার তাল, এমনকি নিঃশ্বাস নেওয়ার ধরণটাও কেমন মিলে যায়? এটাকে বলে ‘মিরর টেকনিক’ বা আয়নার মতো আচরণ। ধরুন, কেউ খুব উত্তেজিত হয়ে কিছু বলছে। আপনি যদি তার মতো একটু ঝুঁকে, তার কথার গতিতে তাল মিলিয়ে শোনেন, সে কিন্তু অবচেতনভাবেই আপনার সাথে একটা মিল খুঁজে পাবে। সে যখন একটু থামবে, আপনিও তাড়াহুড়ো না করে একটু নীরবতা দিন। এটা নকল করা নয়, বরং তার আবেগ সাথে নিজের অনুভূতিকে মিলিয়ে নেওয়া। দেখবেন, আলোচনাটা তখন আর বিতর্ক মনে হবে না, মনে হবে যেন দুটো মন কাছাকাছি আসছে।


২. তাদের মুখের কথাই ফিরিয়ে দিন:

কেউ যখন তার সমস্যার কথা বলতে গিয়ে একটা বিশেষ শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করলো, যেমন ধরুন কেউ বললো, "আমার না আজকাল সবকিছু কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে।" আপনি যদি উত্তরে বলেন, "বুঝতে পারছি, এই দমবন্ধ লাগাটা খুব কষ্টের," সে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ভরসা পাবে যে আপনি সত্যিই তার কথাটা মন দিয়ে শুনেছেন এবং বোঝার চেষ্টা করছেন। অন্যের বলা গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো যখন আলতো করে তার কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তখন সে অনুভব করে যে তাকে শোনা হচ্ছে, গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।


৩. ছোট্ট একটা ‘হ্যাঁ’ দিয়ে শুরু:

অনেক সময় বড় কোনো অনুরোধ করার আগে ছোট ছোট বিষয়ে সম্মতি আদায় করে নিলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। ধরুন, আপনি আপনার নতুন প্রতিবেশীর সাথে আলাপ জমাতে চান। শুরুতেই বড় কোনো আলোচনার দরকার নেই। জিজ্ঞেস করতে পারেন, "আজ আবহাওয়াটা বেশ ভালো, তাই না?" উত্তর আসবে, "হ্যাঁ"। এরপর হয়তো বললেন, "এখানকার বাজারটা কি খুব দূরে?" এভাবে ছোট ছোট ‘হ্যাঁ’ পেতে পেতে যখন আপনি কোনো সাহায্যের জন্য বা একটু গল্প করার জন্য বলবেন, তখন দেখবেন অপর প্রান্ত থেকে ইতিবাচক সাড়া আসছে। এটাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন 'ইয়েস ল্যাডার' বা সম্মতির সিঁড়ি।


৪. নাম ধরে ডাকুন, মনের কাছাকাছি আসুন:

কারও নাম ধরে ডাকলে, বিশেষ করে যখন সে আশা করছে না, তখন তার মনে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়। 'শুনুন' বা 'এই যে ভাই' বলার চেয়ে 'রফিক ভাই, কেমন আছেন?' বললে আলাপের সুরটাই পাল্টে যায়। নিজের নামটা সবার কাছেই খুব প্রিয়। আন্তরিকতার সাথে কারও নাম ধরে ডাকলে সে অবচেতনভাবেই আপনার প্রতি একটু বেশি মনোযোগী হবে, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববে। তবে হ্যাঁ, অতিরিক্ত বা বেমানানভাবে নাম ব্যবহার করলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।


৫. নীরবতার শক্তিকে জানুন:

সবসময় কথা দিয়েই সব সমস্যার সমাধান হয় না। অনেক সময় আমরা উত্তর দেওয়ার জন্য এত ব্যস্ত থাকি যে অন্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজের কথা বলতে শুরু করি। এর বদলে, কেউ কথা শেষ করলে যদি এক মুহূর্ত চুপ থেকে, একটু ভেবে উত্তর দেওয়া যায়, তবে সেই উত্তরের ওজন অনেক বেড়ে যায়। নীরবতাও কিন্তু কথা বলে, আর সেই নীরবতা অনেক সময় শব্দের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়। যখন কেউ রেগে থাকে বা দুঃখ পায়, তখন আপনার শান্ত, নীরব উপস্থিতিই হয়তো তার সবচেয়ে বড় আশ্রয় হতে পারে।


৬. একটু প্রশংসার উষ্ণ ছোঁয়া:

সবারই ভালো লাগে যখন কেউ তার কাজের বা কোনো গুণের প্রশংসা করে। তবে সেই প্রশংসা যদি হয় আন্তরিক, তাহলে তার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। আরও মজার ব্যাপার হলো, কারও অনুপস্থিতিতে যদি তার কোনো ভালো দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং সেই কথাটা যদি কোনোভাবে তার কানে পৌঁছায়, তাহলে সে আপনার প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে। কারণ সে বুঝবে, এই প্রশংসাটা আপনি মন থেকেই করেছেন, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে নয়।


৭. ‘তুমি’ না বলে ‘আমরা’:

কোনো সমস্যায় বা ভুলের ক্ষেত্রে ‘তুমি এটা ভুল করেছো’ বলার চেয়ে যদি বলা যায় ‘দেখি তো, আমরা একসাথে এটা কীভাবে ঠিক করতে পারি’ অথবা ‘মনে হচ্ছে এখানে আমাদের একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে’, তাহলে পুরো পরিস্থিতিটাই ইতিবাচক হয়ে ওঠে। ‘আমরা’ শব্দটা একাত্মতা বোঝায়, আর ‘তুমি’ অনেক সময় অভিযোগের মতো শোনায়। যখন কেউ অনুভব করে আপনি তার দিকে আঙুল না তুলে তার পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তখন সে প্রতিরক্ষামূলক মনোভাব ছেড়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।


৮. ছোট্ট একটা আবদার বা সাহায্য:

অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ, মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কারও কাছে যদি আপনি ছোট্ট একটা সাহায্য চান (যেমন, "আপনার কলমটা একটু দেবেন?" বা "এই ঠিকানাটা খুঁজে পেতে একটু সাহায্য করবেন?") এবং সে যদি সেই সাহায্যটা করে, তাহলে সে আপনার প্রতি আরও বেশি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। কারণ, মানুষ যাকে সাহায্য করে, অবচেতনভাবে তার ভালো চাইতে শুরু করে। এটাকে ‘বেন ফ্রাঙ্কলিন এফেক্ট’ বলা হয়। তবে খেয়াল রাখবেন, আবদারটা যেন সত্যিই ছোট হয় এবং পরিস্থিতি বুঝে হয়।


৯. হাসুন, মন খুলে হাসুন:

একটা আন্তরিক হাসি হাজারো কথার চেয়ে বেশি কাজ দেয়। যখন আপনি কারও দিকে তাকিয়ে হাসেন (অবশ্যই সেই হাসিটা চোখ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, মেকি হাসি নয়), তখন তার মনেও একটা ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। হাসি সংক্রামক। আপনার হাসি দেখে সেও হয়তো একটু হাসবে, আর এই হাসির আদানপ্রদানই দুটো অচেনা মানুষকেও নিমেষে আপন করে নিতে পারে।


১০. অন্যের আগ্রহে আগ্রহী হোন:

পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় মানুষটি কে জানেন? সে, যে নিজে আকর্ষণীয় হওয়ার চেষ্টা না করে অন্যের প্রতি আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয়। যখন আপনি কারও কথা মন দিয়ে শোনেন, তার ভালো লাগা, মন্দ লাগা, তার শখ বা সমস্যা নিয়ে genuine প্রশ্ন করেন, তখন সে অনুভব করে যে আপনি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সবাই চায় কেউ তার কথা শুনুক, তাকে বুঝুক। যখন আপনি সেই মানুষটি হয়ে উঠবেন, তখন দেখবেন সম্পর্কগুলো কেমন আপনাআপনিই সহজ আর সুন্দর হয়ে উঠছে।

Previous Post Next Post