জীবন কি সত্যিই ঘটছে?


জীবন কি সত্যিই ঘটছে আমার মাঝে? নাকি আমি কেবল এক দর্শক, বাইরের প্রান্তে বসে থেকে এই ঘটমান জগতের দৃশ্যপট দেখছি? প্রতিদিন ঘুম ভাঙে, কাজ শুরু হয়, মানুষ দেখি, কথা বলি, নামাজ পড়ি, হাসি-কান্না চলে, সময় কেটে যায়- কিন্তু এর ভেতরে কতটুকু সত্যি ‘ঘটে’? কতটুকু হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা? আর কতটুকু কেবল অভ্যস্ততার এক অভিনয়?

আমরা হাঁটি, কিন্তু কি আমরা পায়ের নিচে মাটির ছোঁয়া টের পাই? আমরা কফি খাই, কিন্তু কফির গন্ধে কি মন থেমে যায়? নামাজে দাঁড়াই, কিন্তু কি আমরা গলে যাই আল্লাহর সামনে? একেকটা অনুভব, একেকটা মুহূর্ত- এসব কি আসলে আমাদের ছুঁয়ে যায়? নাকি সবই ঘটছে আমাদের বাইরে? যেন আমরা কেবল দেখি, কিন্তু ছুঁই না; শুনি, কিন্তু উপলব্ধি করি না।

এভাবে চলতে চলতে আমরা যেন বেঁচে থাকি, কিন্তু জেগে থাকি না। আমাদের অভ্যস্ততা জন্ম দেয় এক ধরনের অচেতনতা। জীবন চলে যায় আমাদের পাশ দিয়ে, আর আমরা ভাবি, “সব তো ঠিকই আছে”- কিন্তু ভেতরটা খালি থাকে। হাসি হয়, কান্না হয়, ভালোবাসাও হয়, কিন্তু সবই যেন নিয়মমাফিক, প্রোগ্রামড। জীবন থেকে প্রাণটা যেন ঝরে পড়ে যায়।

তবুও, কিছু মুহূর্ত আসে, যেগুলো আমাদের থামিয়ে দেয়। একটা মেসেজ, একটি আয়াত, একটি নিঃশব্দ বিকেল, কারো চলে যাওয়া- এসব মুহূর্তে হঠাৎ করে মনে হয়, “এই তো জীবন! এতক্ষণ যা ঘটছিল, তার কোনটাই নয়- এই এখনই আসল।” সেই কম্পন, সেই স্তব্ধতা, সেই ছুঁয়ে যাওয়া বোধ- সেখানেই তো জীবন সত্যি করে ঘটতে শুরু করে।

তবে কি জীবন ঘটে কেবল তখনই, যখন আমরা সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত থাকি? যখন সময় থেমে যায়, চিন্তা স্তব্ধ হয়, মন এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়- আর কেবল অনুভব রয়ে যায়? জীবন তখন কেবল এক বহিরঙ্গ দৃশ্য নয়, তখন তা ঘটে যায় আমাদের ভেতর, আমাদের অস্তিত্বে। তখন আমরা শুধু জীবনকে দেখি না, আমরা হয়ে যাই জীবন নিজেই।

আমরা হয়তো সারাদিন মানুষ দেখি, কথা বলি, হাঁটি, ভালোবাসি- তবু খুব কম সময়েই আমরা সত্যিকারের স্পর্শ পাই কারো। খুব কম মানুষই আমাদের হৃদয়ে ‘ঘটে’। বাকিরা শুধু পাশ কাটিয়ে যায়। জীবনও তেমন- কেউ কেউ জীবনকে জড়িয়ে ধরে, ধ্যান করে, কাঁদে, থেমে যায়; আর কেউ কেউ শুধু তালিকা শেষ করতে করতে পার হয়ে যায়- এবং একদিন হঠাৎ বোঝে, সব শেষ।

জীবন তখনই সত্যিই ঘটতে শুরু করে, যখন আমরা ‘এই মুহূর্তে’ পুরোপুরি উপস্থিত থাকি।

ভবিষ্যতের চিন্তা নয়, অতীতের স্মৃতি নয়- এই এখনটাকেই দুই হাতে তুলে ধরি। সূর্য উঠছে, চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে, দূরে কেউ হাঁটছে, পাখিরা ডাকছে- এইসব ছোট ছোট ঘটনার মাঝেই জীবন পুরোটা খুলে পড়ে, যদি আমরা খোলা হৃদয়ে তাকাতে পারি।

আল্লাহ আমাদের একটি হৃদয় দিয়েছেন- এমন এক জাগ্রত কেন্দ্র, যার ভেতর দিয়ে আমরা জীবনকে উপলব্ধি করতে পারি। তাকেই অনুভব করতে পারি, তাঁর সৃষ্টিকে আবিষ্কার করতে পারি, এবং ঘটমান সময়ের ভেতরে জেগে থাকা শিখতে পারি। দৃষ্টির বাইরেও এক অনুভব আছে, শব্দের বাইরেও এক নীরবতা- যেখানে জীবন নিজেই কথা বলে।

জীবন কি ঘটছে? হ্যাঁ, প্রতিটি মুহূর্তেই। কিন্তু তুমি কি সেখানে আছো? তুমি কি এই ঘটনার অংশ, না কেবল এক নীরব দর্শক? তুমি কি জীবনকে বাঁচছো, নাকি কেবল পার হয়ে যাচ্ছো?
Previous Post Next Post