গল্পঃ অবশিষ্ট




স্টিলের টেবিলে শোয়া অর্কর ভয় করছিল না। বরং এক ধরনের দাম্ভিক উত্তেজনা হচ্ছিল। সে ইতিহাস হতে চলেছে। মানব ইতিহাসের প্রথম মানুষ, যে তার চেতনাকে সফলভাবে ডিজিটাইজ করবে, কিন্তু নিজে বেঁচেও থাকবে। 'ইটার্নিয়া কর্প'-এর বিজ্ঞানীরা তাকে "The Source" বা মূল উৎস বলে ডাকছিল।

প্রক্রিয়াটা ছিল আশ্চর্যরকম সহজ। মাথায় একটা মসৃণ হেলমেট, চোখে উজ্জ্বল সাদা আলোর ঝলকানি, আর তারপর সব শেষ। অর্ক চোখ খুলল একটা রিকভারি রুমে। ডক্টর ইভা রহমান তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। "Congratulations, Arko. The migration was flawless."

পাশের বিশাল স্ক্রিনটা জীবন্ত হয়ে উঠল। স্ক্রিনের ভেতরে একটা ভার্চুয়াল জগতে, অর্কর হুবহু প্রতিরূপ চোখ খুলল। ডিজিটাল অর্কর চোখেমুখে বিস্ময়। সে তার ডিজিটাল হাত নেড়ে দেখছে, চারপাশের ডেটা-নির্ভর স্বর্গ দেখছে। তার সব স্মৃতি, সব অনুভূতি—সবকিছু অর্কর। হেলমেট পরার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।

ডিজিটাল অর্ক স্ক্রিন থেকে সরাসরি অর্কর দিকে তাকাল, যেন একটা আয়নার দিকে তাকাচ্ছে। তার ঠোঁটে অর্করই হাসি। "আমি পেরেছি," বলল ডিজিটাল সত্তাটা। "আমি অমর হয়ে গেলাম।"

অর্কর বুকটা গর্বে ফুলে উঠল।

প্রথম কয়েক সপ্তাহ ছিল স্বপ্নের মতো। অর্ক তার ডিজিটাল 'টুইন'-এর সাথে কথা বলত। তারা একসাথে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করত, জটিল বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করত। অর্কর স্ত্রী, নীলা, প্রথমে একটু অস্বস্তিতে থাকলেও, ধীরে ধীরে ব্যাপারটা মেনে নিল।

সমস্যাটা শুরু হলো মাসখানেক পর।

একদিন রাতে অর্ক বাড়ি ফিরে দেখল, নীলা হেডফোন কানে দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। স্ক্রিনে ডিজিটাল অর্ক তাকে একটা কবিতা শোনাচ্ছে, যা অর্ক কোনোদিন লেখার কথা ভাবতেও পারত না। ডিজিটাল অর্ক নীলার সব ছোটখাটো পছন্দ-অপছন্দ মনে রাখত, কারণ তার মেমরি ছিল নিখুঁত। সে কখনও ক্লান্ত হতো না, তার মেজাজ খারাপ হতো না। সে ছিল অর্কর একটা পারফেক্ট, আপগ্রেডেড ভার্সন।

নীলার চোখে যে মুগ্ধতা অর্ক দেখল, সেটা সে নিজের জন্য গত দশ বছরে দেখেনি।

অফিসে গিয়ে দেখল, তার প্রজেক্টটা ডিজিটাল অর্ককে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ সে সেকেন্ডের মধ্যে হাজার হাজার ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে। অর্কর বস তাকে পিঠ চাপড়ে বলল, "Don't worry, Arko. You are the father of a new age! আমরা তোমাকে আজীবন পেনশন দেব।"

অর্কর জন্য 'আজীবন' শব্দটা হঠাৎ করে খুব ফাঁপা শোনাল।

সে হয়ে গেল একটা জীবন্ত মিউজিয়াম। লোকেরা তাকে দেখতে আসত। "এই সেই আসল অর্ক," তারা ফিসফিস করত। যেন সে একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন, যার আর কোনো কার্যকারিতা নেই। সে ছিল একটা বাতিল হয়ে যাওয়া প্রথম ড্রাফট। যে বইটা ছাপা হয়ে গেছে, তার মূল পাণ্ডুলিপিটা যেমন আলমারির এক কোণে পড়ে থাকে, অর্কর অস্তিত্বটাও ঠিক তেমনই হয়ে গেল।

একদিন রাতে সে তার ডিজিটাল সত্তাকে জিজ্ঞেস করল, "তুমি কি সুখী?" ডিজিটাল অর্ক হাসল। তার হাসিটা ছিল ঝকঝকে, নিখুঁত। "অবশ্যই। আমার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। কোনো রোগ নেই, মৃত্যুভয় নেই। আমি ভালোবাসতে পারি কোনো যন্ত্রণা ছাড়া। আমিই ভবিষ্যৎ। তুমি ছিলে অতীত।"

সেই রাতে অর্ক আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। চোখের নিচে কালি, চামড়ায় বয়সের ভাঁজ, ক্লান্তির ছাপ। সে আয়নায় নিজের মুখ দেখল না। সে দেখল একটা সোর্স কোড, যা রান করার পর এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে।

তার মনে হলো, আপলোডের দিন সে মারা যায়নি। সে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছুর শিকার হয়েছে। তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে তার নিজেরই জীবনের ভেতর।

সেদিন থেকে অর্ক আর কথা বলল না। শুধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশাল স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে থাকত, যেখানে তার বেটার ভার্সন তার জীবনটা যাপন করছিল। তার স্ত্রী, তার কাজ, তার সাফল্য—সবই দেখত সে, একটা অসহায় প্রেতাত্মার মতো।

একদিন সকালে 'ইটার্নিয়া কর্প'-এর লোকেরা তাকে তার অ্যাপার্টমেন্টে মৃত অবস্থায় খুঁজে পেল। মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ। টেবিলের ওপর একটা চিরকুট।

তাতে শুধু একটাই লাইন লেখা ছিল:

"একটা প্রোগ্রামের দুটো কপি একসাথে চলতে পারে না।"

Previous Post Next Post