যখন কিছুই করার থাকে না


 নিস্তব্ধতায় ডুবে যাওয়া সেই মুহূর্তগুলো, যখন সময় স্থির হয়ে যায়। হাতে কোন কাজ নেই, মনে কোন তাড়না নেই। শুধু বিশাল এক শূন্যতা। আমরা এই শূন্যতাকে কতটা ভয় পাই, তাই না? আমাদের মধ্যে অনেকেই এই "কিছু না করার" মুহূর্তগুলোকে এক ধরনের অপরাধবোধ নিয়ে দেখি। কিন্তু এই শূন্যতাই যদি হয় সমস্ত সৃষ্টির আদিম উৎস?

গভীর একটি কূপের মত এই শূন্যতা। প্রথমে দেখে মনে হয় অন্ধকার, নিঃসঙ্গ। কিন্তু যখন চোখ অভ্যস্ত হয়ে আসে, তখন দেখা যায় এই 'কিছু না করার' মধ্যেই লুকিয়ে আছে অসংখ্য সম্ভাবনার বীজ। ঠিক যেমন বীজ মাটির অন্ধকারে নিস্তব্ধ থাকে, তারপর একদিন অঙ্কুরিত হয়ে আলোর দিকে উঠে আসে।

একটি বাগানের কথা ভাবুন। বাগানে কখনও কি লক্ষ্য করেছেন সেই মুহূর্তগুলো, যখন কোন পাতা নড়ে না, কোন পাখি ডাকে না? বাইরে থেকে মনে হয়, কিছুই ঘটছে না। কিন্তু মাটির নীচে? সেখানে শিকড়গুলো নিরন্তর কাজ করে চলেছে, পুষ্টি শোষণ করছে, জীবনরস সঞ্চালন করছে। দেখা যায় না, কিন্তু বাগানের প্রতিটি উজ্জ্বল ফুল, প্রতিটি সতেজ পাতার পেছনে আছে এই অদৃশ্য নিঃশব্দ প্রক্রিয়া।

আমাদের জীবনেও, যখন কিছু করার থাকে না, তখন সেই মুহূর্তগুলো আসলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাগানের জন্য একটি বিরাম। আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন কি, মন কেন এতো দ্রুত ব্যস্ততা খোঁজে? ঠিক যেন নিস্তব্ধতার ভীতি থেকে পালাতে চায়। আমরা মোবাইল ফোন হাতে তুলে নিই, টিভি চালিয়ে দিই, নিজেকে ব্যস্ত রাখার হাজার উপায় খুঁজে বের করি।

কিন্তু আল্লাহ্‌ তা'আলা কি আমাদের শুধু 'করার' জন্যই সৃষ্টি করেছেন? না কি 'হওয়ার' জন্যও? কুরআন মাজিদে আল্লাহ্‌ বলেন, "তিনি প্রতিটি জিনিসকে সৃষ্টি করেছেন, এবং তার পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন" (সূরা আল-ফুরকান, ২৫:২)। এই আয়াতে লুকিয়ে আছে এক গভীর বার্তা - প্রতিটি জিনিসেরই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে - কর্ম এবং বিরামেরও।

মহানবী (সা.) নিজেও একান্ত নিঃসঙ্গতা ও নিঃস্তবদ্ধতা ভালোবাসতেন। হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকার সেই মুহূর্তগুলো কি তাঁর জীবনে অকর্মণ্যতা ছিল? না, বরং সেই নিস্তব্ধতাই তাঁকে প্রস্তুত করেছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বার্তা গ্রহণ করার জন্য।

তাহলে, যখন আমরা "কিছু করার নেই" এমন মুহূর্তে পড়ি, তখন সেই সময়কে আমরা কীভাবে দেখব? ভয়ের চোখে, না সম্ভাবনার চোখে? একটি খালি কাগজ যেমন লেখকের সামনে অসংখ্য সম্ভাবনা উন্মোচন করে, তেমনি এই 'খালি সময়' আমাদের সামনে আত্ম-আবিষ্কারের নতুন দরজা খুলে দেয়।

প্রশ্ন করুন নিজেকে: যখন বাইরের সমস্ত আওয়াজ থেমে যায়, তখন কী শুনতে পান? হয়তো নিজের হৃদস্পন্দন? হয়তো মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কোন আকাঙ্ক্ষা? বা হয়তো মহাবিশ্বের সেই অনন্ত শব্দ, যা সবসময় বয়ে চলেছে, কিন্তু আমরা ব্যস্ততার কোলাহলে তা শুনতে পাই না?

একটি ছোট্ট অনুশীলন করুন। আগামী কয়েকটি মিনিট, কিছুই করবেন না। না ভাববেন, না পরিকল্পনা করবেন। শুধু আপনার শ্বাসের গতি অনুভব করুন। দেখুন কী ঘটে। হয়তো প্রথমে অস্বস্তি লাগবে, মন ছুটতে চাইবে। তারপর, ধীরে ধীরে, এক অদ্ভুত শান্তি নেমে আসবে। আপনি অনুভব করবেন, 'কিছু না করা'ই আসলে অনেক কিছু করা - নিজের সাথে পুনর্মিলিত হওয়া।

মহাকবি জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, "নীরবতা হল ভাষা সেই পরমসত্তার, যিনি সবকিছু।" আমাদের নিস্তব্ধতার মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে সেই ভাষা, যা দিয়ে আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারি।

তরুণ প্রজন্মের কাছে এই বার্তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। একটি সময়ে যেখানে পৃথিবী কখনো থামে না, নোটিফিকেশন কখনো শেষ হয় না, সেখানে নিজের জন্য 'কিছু না করার সময়' বের করাটাও এক ধরনের সাহসিকতা। এটি নিজের প্রতি একটি উপহার, নিজেকে ফিরে পাওয়ার একটি সুযোগ।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ বলেন, "নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে" (সূরা আর-রা'দ, ১৩:১১)। এই আয়াতের একটি গভীর অর্থ হতে পারে - পরিবর্তনের জন্য আমাদের প্রথমে নিজেদের অভ্যন্তরে যেতে হবে, নিজেদের চিনতে হবে। আর সেই আত্ম-অন্বেষণের জন্য 'কিছু না করার' মুহূর্তগুলো অমূল্য।

একটি চিন্তা করুন - আপনি যদি সারাদিন দৌড়াতে থাকেন, কখন দেখবেন আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন? যখন থামবেন, কেবল তখনই। যখন কিছু করার থাকে না, তখনই আমরা আমাদের যাত্রাপথ দেখতে পাই, আমাদের দিকনির্দেশনা পরীক্ষা করতে পারি।

তাই আজ, যখন আপনি নিজেকে এমন এক মুহূর্তে পাবেন যেখানে 'কিছু করার নেই', তখন সেই মুহূর্তকে আলিঙ্গন করুন। ভয় পাবেন না। বরং একটি সম্ভাবনা হিসেবে দেখুন - নিজের সাথে, আপনার সৃষ্টিকর্তার সাথে, এবং আপনার জীবনের গভীরতম অর্থের সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি সুবর্ণ সুযোগ।

কারণ, জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলো প্রায়ই সবচেয়ে নিঃশব্দ হয়ে আসে, যেমন শ্বাস, যেমন ভালোবাসা, যেমন বিশ্বাস। তাই, পরবর্তী বার যখন আপনি নিজেকে 'কিছু না করার' মুহূর্তে পাবেন, নিজেকে বলুন: "আমি কিছু করছি না, আমি হচ্ছি।" আর সেই 'হওয়া'র মধ্যেই রয়েছে আমাদের অস্তিত্বের সর্বোচ্চ পূর্ণতা।


Previous Post Next Post