'উইন-উইন': সমাজ ও প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা



একবিংশ শতাব্দীর এই পর্যায়ে এসে আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সংযুক্ত এবং জনবহুল। এই বিশ্বায়ন একদিকে যেমন অগ্রগতির সুযোগ এনে দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য এবং প্রযুক্তির দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহারের মতো ভয়াবহ চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। এই জটিল পরিস্থিতিগুলো উপেক্ষা করে কেবল প্রবৃদ্ধির পেছনে ছোটা সম্ভব নয়। যদি আমরা এই সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করতে চাই, তবে এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোকে সর্বাগ্রে মোকাবেলা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন এক ভিন্ন ধরনের মানসিকতা ও কার্যপ্রণালী, যাকে একটি সামগ্রিক ‘দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধান’ বা স্টিওয়ার্ডশিপ বলা যেতে পারে।

এই দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধানের ধারণাটি নিছক কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়, এটি একটি বাস্তব অনুশীলন। এর মূল লক্ষ্য হলো এমনভাবে মূল্য সৃষ্টি করা যা কেবল তাৎক্ষণিক অংশীদারদের (স্টেকহোল্ডার) স্বার্থই রক্ষা করে না, বরং বৃহত্তর সমাজ, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং সর্বোপরি আমাদের পরিবেশের চাহিদাগুলোকেও সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। এটি একটি গভীর দর্শন যা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কার্যক্রমের সম্পূর্ণ সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের দায়ভার নিতে উৎসাহিত করে। এটি আমাদের গ্রহের সীমিত সম্পদকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত রাখার এক জোরালো অঙ্গীকার। প্রচলিত ব্যবসায়িক মডেলগুলো প্রায়শই স্বল্পমেয়াদী লাভের ওপর অতিমাত্রায় মনোনিবেশ করে, কিন্তু এই পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়।

কেবল পুঁজি, প্রণোদনা বা কঠোর আইন-কানুন দিয়ে পৃথিবীর এই অস্তিত্বগত সংকটগুলোর সমাধান সম্ভব নয়। এসবের পাশাপাশি যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো, একটি মূল্যবোধ-চালিত নেতৃত্ব, যা একটি সমষ্টিগত উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই ধরনের নেতৃত্বকে ‘স্টিওয়ার্ড লিডারশিপ’ বা ‘দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধায়ক নেতৃত্ব’ বলা যায়। এই নেতৃত্ব গড়ে ওঠে কয়েকটি মৌলিক মূল্যবোধের ওপর। এর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হলো পারষ্পরিক নির্ভরতার গভীর উপলব্ধি। অর্থাৎ, এই সত্যটি অনুধাবন করা যে, আমার সাফল্য আপনার সাফল্যের ওপর এবং আপনার সাফল্য আমার সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল। আমরা কেউ একা নই; আমাদের ভাগ্য একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এই পারষ্পরিক নির্ভরতার বোধ থেকেই দ্বিতীয় মূল্যবোধটির জন্ম হয়: একটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি। আজকের দিনের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের জন্য বীজ বপন করে। তাই তাৎক্ষণিক লাভের লোভে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না যা ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। এর সাথে আসে তৃতীয় মূল্যবোধ: মালিকানার মানসিকতা। এর অর্থ হলো, কেবল নিজের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করাই যথেষ্ট নয়, বরং একটি উন্নততর সামষ্টিক ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে proactive ভূমিকা গ্রহণ করা। শেষ পর্যন্ত, চতুর্থ স্তম্ভটি হলো সৃজনশীল সহনশীলতা (creative resilience)। এই পথটি সহজ নয়, তাই ক্রমাগত উদ্ভাবন, নতুন কিছু শেখার আগ্রহ এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে হাল না ছেড়ে লেগে থাকার অভ্যাসকে সংস্কৃতির অংশ করে তুলতে হয়।

এই চারটি মূল্যবোধ যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের ডিএনএ-তে প্রোথিত হয়, তখন তার ভিত্তিতে একটি সুস্পষ্ট ‘স্টিওয়ার্ডশিপ উদ্দেশ্য’ বা দায়িত্বশীল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা অপরিহার্য। এই উদ্দেশ্যকে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়: প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বকে ঠিক কোন প্রয়োজনীয় পণ্য বা পরিষেবা দিচ্ছে? লাভের বাইরে সমাজের জন্য এর অর্থবহ অবদান কী? এবং কেন তারা এই কাজটি করছে? যখন এই উদ্দেশ্য स्पष्ट হয়ে যায়, তখন এটিই ভালো এবং খারাপ—উভয় সময়েই প্রতিষ্ঠানের সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি ধ্রুবতারা বা গাইড হিসেবে কাজ করে।

যেসব প্রতিষ্ঠান এই দায়িত্বশীলতার পথকে অগ্রাধিকার দেয়, তারা সুস্পষ্টভাবেই উপকৃত হয়। তারা তাদের পারিপার্শ্বিক সমাজ এবং পরিবেশের কাছ থেকে বৃহত্তর গ্রহণযোগ্যতা পায়, যা তাদের কার্যক্রমকে অনেক সহজ করে তোলে এবং কম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এটি কেবল শীর্ষ নেতৃত্বের বিষয় নয়; প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সদস্যের, সে যে পদেই থাকুক না কেন, একজন মালিকের মতো চিন্তা ও কাজ করার দায়িত্ব রয়েছে। এই ধরনের নেতৃত্বের চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ হলো কেবল একটি ‘উইন-উইন’ বা উভয় পক্ষের লাভজনক পরিস্থিতি তৈরি করা নয়, কারণ তা আর যথেষ্ট নয়। আসল লক্ষ্য হলো একটি ‘উইন-উইন-উইন’ ফলাফল অর্জন করা—যেখানে কর্মীরা সন্তুষ্ট ও অনুপ্রাণিত থাকেন, শেয়ারহোল্ডাররা ন্যায্য মূল্য পান এবং একই সাথে বৃহত্তর সমাজও বাস্তবিকভাবে উপকৃত হয়। এটাই হলো টেকসই সাফল্যের মূলমন্ত্র।

Previous Post Next Post