আমরা কি আসলেও বাস্তবতা দেখি? নাকি এ স্রেফ মস্তিষ্কের তৈরি একটি সিমুলেশন?



আমরা প্রতিদিন যা দেখি, শুনি বা অনুভব করি, তা কি আসলেই 'বাস্তবতা'? নাকি আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য সুবিধাজনক একটি 'সিমুলেশন' বা ব্যাখ্যা তৈরি করে দেখাচ্ছে?


মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নিয়ে কিছু মূলনীতি বিশ্লেষণ করলে এর উত্তর বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উত্তরটি হলো-- আমরা সম্ভবত সরাসরি 'বাস্তবতা' (raw reality) দেখি না। বরং, আমাদের মস্তিষ্ক বাস্তবতাকে আমাদের জন্য 'প্রসেস' বা 'ফিল্টার' করে দেখায়।


এর সপক্ষে কয়েকটি যুক্তি দেখা যাক:


১. ফোকাসের শক্তি একটি মূলনীতি হলো: "আপনি যা ফোকাস করেন, তা-ই প্রসারিত হয়।" যদি বাস্তবতা সবার জন্য এক ও অপরিবর্তনীয় হতো, তবে আমাদের ফোকাসের ওপর আমাদের উপলব্ধি নির্ভর করত না।


আপনি যখন কৃতজ্ঞতার দিকে মনোযোগ দেন, তখন চারপাশের ভালো জিনিসগুলোই আপনার চোখে বেশি ধরা পড়ে। এর মানে হলো, আপনার মস্তিষ্ক আপনার মনোযোগ অনুযায়ী বাস্তবতার একটি নির্দিষ্ট অংশকে আপনার সামনে 'জুম ইন' বা হাইলাইট করে দেখাচ্ছে। এটি স্রেফ তথ্য গ্রহণ নয়, এটি তথ্য 'সম্পাদনা'।


২. মস্তিষ্কের নিজস্ব ফিল্টার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো "ফিল্টারিং মানসিকতা"। একই ঘটনা বা তথ্য একজন বিশ্বাসীর বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে, আবার ঠিক একই তথ্য একজন সন্দেহবাদীর মনে আরও সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়।


ঘটনা বা 'বাস্তবতা' কিন্তু একটাই। পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতরের 'ফিল্টার' বা আগে থেকে তৈরি করা প্রোগ্রামিং। আমরা জগতকে সরাসরি দেখি না, বরং আমাদের ভেতরের এই ফিল্টার দিয়ে প্রসেস করে দেখি। মস্তিষ্ক তার প্রোগ্রামিং অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন তথ্যটি আমাদের জন্য উপযুক্ত।


৩. বেঁচে থাকার প্রোগ্রামিং এই সিমুলেশনের মূল উদ্দেশ্য কী? সম্ভবত, বেঁচে থাকা। একটি নীতি বলছে: "ভয় একটি শেখা প্রতিক্রিয়া।" ভয় আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি অনুভূতিগুলোর একটি। কিন্তু এটি কোনো বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা নয়, বরং একটি 'প্রোগ্রাম' যা আমাদের শেখানো হয়েছে বা আমরা সময়ের সাথে শিখেছি। মস্তিষ্ক বিপদ এড়ানোর জন্য (অর্থাৎ, বেঁচে থাকার জন্য) এই ভয় নামক সিমুলেশনটি প্রয়োজন হলেই চালু করে দেয়।


৪. বাস্তব আর কল্পনার মিশ্রণ সবচেয়ে বড় প্রমাণটি সম্ভবত এটি: "আপনার মস্তিষ্ক সবসময় বাস্তবতা এবং আপনি তাকে যা বলেন, তার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না।"


এই কারণেই "ইতিবাচক নিশ্চিতকরণ" বা পজিটিভ অ্যাফারমেশন (যেমন "আমি জিতছি") কাজ করে। আপনি যখন মস্তিষ্ককে কোনো কথা বারবার বলেন, মস্তিষ্ক সেটাকে সত্য বলে ধরে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করা শুরু করে। যদি মস্তিষ্ক বাস্তবতার একটি নিখুঁত এবং অপরিবর্তনীয় চিত্র দেখত, তবে এই ধরনের কথা দিয়ে তাকে কখনোই প্রভাবিত করা যেত না।


উপসংহার সুতরাং, এই নীতিগুলো অনুযায়ী এটা বলাই যায় যে, আমরা 'কাঁচা' বাস্তবতা (raw reality) দেখি না। আমাদের মস্তিষ্ক একটি অসাধারণ 'কন্ট্রোল সেন্টার'। এটি বাইরের জগত থেকে তথ্য গ্রহণ করে, তারপর সেগুলোকে আমাদের ফোকাস, বিশ্বাস এবং বেঁচে থাকার প্রয়োজন অনুযায়ী ফিল্টার ও প্রসেস করে।


সবশেষে, আমাদের সামনে সেই প্রসেস করা 'ভার্সন' বা 'সিমুলেশনটিকেই' বাস্তবতা হিসেবে তুলে ধরে, যা আমাদের টিকে থাকতে এবং সফল হতে সাহায্য করে।

Previous Post Next Post