অভিজ্ঞতার নিঃসঙ্গতা


এই বিশাল মহাবিশ্বে আমি কতটুকু? আমার চিন্তা, আমার অনুভূতি, আমার বেদনা - এসব কি শুধুই আমার? কেউ কি সত্যিই বুঝতে পারে আমি কী অনুভব করছি?

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকে একটি অনন্য সৃষ্টি হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে একটি দুনিয়া আছে যা শুধু আমরাই অনুভব করি। তোমার মনের ভাবনা, তোমার হৃদয়ের স্পন্দন, তোমার আত্মার গভীরতা - এসব কি সত্যিই কেউ সম্পূর্ণভাবে জানতে পারে?

যখন তুমি চোখ বন্ধ করে নিজের ভিতরে তাকাও, সেখানে এমন অনুভূতির জগৎ আছে, যা শুধু তোমারই। তোমার সবচেয়ে আপন অনুভূতি, তোমার সবচেয়ে গোপন চিন্তা, তোমার সবচেয়ে গভীর আকাঙ্ক্ষা - এসব তোমার একান্ত নিজস্ব। কেউ কি সত্যিই বুঝতে পারে তোমার বেদনার গভীরতা? কেউ কি সত্যিই অনুভব করতে পারে তোমার আনন্দের উচ্ছ্বাস?

কোরআন শরীফে আল্লাহ বলেন: "আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমি জানি তার মনে কী বিচরণ করে।" (৫০ঃ১৬) 

তবুও, আমরা কি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ? আমি যখন তোমার চোখে চোখ রাখি, যখন তোমার হাসি দেখি, তখন কি কিছুটা হলেও তোমাকে বুঝতে পারি না?

আমাদের ভাষা, আমাদের অভিব্যক্তি, আমাদের সহানুভূতি - এসবই কি সেতু নয়? যখন তুমি কাঁদো, আমিও কি তোমার বেদনা অনুভব করি না? যখন তুমি হাসো, আমার হৃদয়ও কি আলোকিত হয় না?

রাসূল (সাঃ) বলেছেন: "মুমিনরা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল, ভালোবাসায় ও সহমর্মিতায় তারা একটি দেহের মতো। যখন তার একটি অঙ্গ ব্যথা পায়, সমগ্র দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় কষ্ট পায়।"

আমরা নিজেদের একক অস্তিত্বে আবদ্ধ থাকি, কিন্তু সেই সাথে আমরা সংযুক্তও। যখন আমি তোমার সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করি, আমার আত্মা যেন তোমার আত্মাকে স্পর্শ করে। এই মুহূর্তে আমরা কি আর একা থাকি?

আমাদের দু'জনের অভিজ্ঞতা ভিন্ন, কিন্তু আমরা যখন একসাথে একই সূর্যাস্ত দেখি, একই সুরে গান গাই, একই আল্লাহর কাছে সিজদা করি - তখন কি আমরা শুধুই পৃথক থাকি?

সাহাবি আবু ঝার (রাঃ) বলেন, একবার নবী (সাঃ) তাকে বললেন: "তোমার ভাইয়ের মুখে হাসি দেখানোও সদকার সমান।" এই হাসি, এই সংযোগ - এর মাধ্যমে কি আমরা একে অপরের অভিজ্ঞতায় অংশীদার হই না?

হ্যাঁ, আমরা প্রত্যেকে নিজের অভিজ্ঞতার নিঃসঙ্গতায় বাস করি। কিন্তু এই নিঃসঙ্গতা থেকেই আমরা সংযোগ খুঁজি। আমি যখন তোমার সামনে আমার হৃদয় খুলে ধরি, তখন সেই নিঃসঙ্গতার দেয়াল ভেঙে পড়ে।

প্রতিটি প্রার্থনায়, আমরা আল্লাহর কাছে তাকাই। তিনি আমাদের সবার হৃদয় জানেন। তাঁর মাধ্যমে আমরা পরস্পরকে খুঁজে পাই।

আমাদের নিঃসঙ্গতা সত্য, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। আমাদের যাত্রা একক হলেও, পথ একটাই - আল্লাহর দিকে। এবং সেই পথে আমরা একে অপরের সাথী।

আমরা হয়তো কখনোই একে অপরের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ অংশীদার হতে পারব না, কিন্তু আমরা একসাথে হাঁটতে পারি, একসাথে অনুভব করতে পারি, একসাথে আল্লাহর দিকে যেতে পারি।

এবং হয়তো, এই সত্যই আমাদের নিঃসঙ্গতাকে এত সুন্দর করে তোলে। কারণ নিঃসঙ্গতার মধ্যেই আমরা সংযোগের তৃষ্ণা অনুভব করি, আর সেই তৃষ্ণাই আমাদের জীবনে অর্থ যোগ করে।


Previous Post Next Post